পবিত্র লীলা মনে পড়ে এবং মানসী-পূজার জন্য যে নৈবেদ্য সাজাইয়া থাকি, বিদ্যাপতির পূর্ব্ব-চিত্রণে তাহার লেশমাত্র নাই। সহচরীরাও তাঁহার কর্ণান্ত-অবলম্বি কেশপাশ আঁচড়াইয়া বেণী বাঁধিয়া দিতেছেন, রাধিকা অতি গোপনে তাঁহাদের কাণে কাণে প্রেমলীলা সম্বন্ধে শিষ্ট-অশিষ্ট নানারূপ প্রশ্ন করিতেছেন; কখনও নবযৌবনাগমে তাঁহার দেহ-সৌন্দর্য্য-স্ফুরণের আভাস মুকুরে প্রতিবিম্বিত দেখিয়া মৃদু মৃদু হাসিতেছেন। যেখানে কোনও প্রণয়ঘটিত কথাবার্ত্তা হয়, সেইখানে তিনি আনতমুখী হইয়া বাহ্যে উদাসীনতা দেখাইলেও, চৌর্য্যবৃত্তিপূর্ব্বক অতি আগ্রহে সে-সকল কথা শুনিতে থাকেন (“আনতমুখে ততহি দেহি কাণে”); এইভাব যদি ধরা পড়ে এবং কোন সখী তাহা প্রচার করিয়া দেয়, তবে একবারে রৌদ্রবৃষ্টি, (‘কান্দন মাখি হাসি দেয় গারি’) রাধা তখন মুখে হাসি এবং চোখে কান্না লইয়া সখীকে গালি দিতে থাকেন। কবি বলিতেছেন—‘মনমত পাঠ পহিল অনুবন্ধ’—কামদেবের শাস্ত্রে নূতন পাঠ লইতেছেন। মোটকথা রাধিকার পূর্ব্বরাগের ছবিগুলি সংস্কৃত অলঙ্কার-শাস্ত্রের এক-একখানি পটবিশেষ। অভিসার ও স্নানের পর রাধিকার যে সকল চিত্র বিদ্যাপতি দেখাইয়াছেন, তাহা দেহসুখলোলুপ তরুণ-মনের উপাদেয় খোরাক। সেগুলি খুব সুনিপুণ কবির হাতের যোগ্য—কাব্যজগতে তাহা নিরূপম। কিন্তু তাহার উপমা ও উৎপ্রেক্ষা চোখে ধাঁধাঁ লাগাইলেও, সে চিত্র মেঘদূতের যক্ষীও নহে, কালিদাসের শকুন্তলাও নহে। ঐ দুই কবি কাব্যের উত্তরার্দ্ধে ভোগনিবৃত্তিজনিত প্রেমের নির্দ্দোষ পরিসমাপ্তি দেখাইয়াছেন। বিদ্যাপতির ভোগের চিত্র চিরকালই ভোগীকে লুব্ধ করিবে, কিন্তু চণ্ডীদাস হইতে কৃষ্ণকমল পর্য্যন্ত বৈষ্ণব কবিদের যে-সকল চিত্র আমরা দেখিয়াছি, তাহার অনেক পদই সংকীর্ত্তন-ভূমির রজঃ মাখা, তাহা মানব-হৃদয়ের চিরন্তন কারুণ্য ও
পাতা:পদাবলী-মাধুর্য্য.djvu/১৫৫
এই পাতাটিকে বৈধকরণ করা হয়েছে। পাতাটিতে কোনো প্রকার ভুল পেলে তা ঠিক করুন বা জানান।
পদাবলী-মাধুর্য্য
১৪৯