পাতা:পদাবলী-মাধুর্য্য.djvu/১৫৭

এই পাতাটিকে বৈধকরণ করা হয়েছে। পাতাটিতে কোনো প্রকার ভুল পেলে তা ঠিক করুন বা জানান।
পদাবলী-মাধুর্য্য
১৫১

পুনরাবৃত্তি নহে। চণ্ডীদাসের সঙ্গে তাঁহার দেখা হইয়াছিল, পদ-কল্পতরুর অনেক পদে তাঁহাদের কথোপকথনের ‍সারাংশ সঙ্কলিত হইয়াছে। এই সাক্ষাৎকারের ফলে প্রেম যে অখণ্ড জিনিষ, সর্ব্ববর্ণের সংমিশ্রনের পরিণতি যেরূপ শ্বেত বর্ণ,—বাৎসল্য, সখ্য, ভগবদ্ভক্তি প্রভৃতি সমস্ত রসই একস্থানে যাইয়া মিশিয়া যায়—তখন ইহাদের মধ্যে কোন ভেদ থাকে না, এই সকল কথা চণ্ডীদাস বিদ্যাপতিকে সম্ভবতঃ বলিয়াছিলেন। পদ-কল্পতরুতে বর্ণিত আছে, চণ্ডীদাস মৈথিল কবিকে জিজ্ঞাসা করিয়াছিলেন, যৌন-লালসা হইতেই শুদ্ধ প্রেম হয়, কিম্বা প্রেমেরই স্বাভাবিক ক্রমে যৌনভাব শেষে আসিয়া পড়ে। বিদ্যাপতির প্রথম ‍অধ্যায়গুলি সমস্তই অলঙ্কার-শাস্ত্রের অনুযায়ী, কিন্তু মাথুর ও ভাব-সম্মেলনে তিনি ভাবরাজ্যে বাঙালী বৈষ্ণব কবিদের মূল সুর ধরিয়াছেন, ইহাতে বোধ হয়, এই পরিবর্ত্তন চণ্ডীদাসের সঙ্গে তাঁহার দেখাশুনার ফলে ঘটিয়াছিল। বিদ্যাপতি ‘মাথুর’ বর্ণনায় সেই রসের পরিপূর্ণ আস্বাদ আমাদিগকে দিয়াছেন। আমরা দেখাইয়াছি—“সোহি কোকিল অব লাখ ডাকউ”—পদটি তিনি চণ্ডীদাস হইতে গ্রহণ করিয়া পল্লবিত করিয়াছেন। তাঁহার ছিল অপ্রতিদ্বন্দী কবির ভাষা, সেই ভাষায় যখন তিনি মাথুর বর্ণনা করিলেন, তখন তাঁহার পদাবলীতে সমস্ত ভোগের চিহ্ন মুছিয়া গিয়াছে; তখন তিনি পবিত্র তিলক-কণ্ঠী-ধারী বৈষ্ণবগুরু—“শ্রবণে হি শ্যাম করু গান, শুনইতে নিকলাউ কঠিন পরাণ”, তখন “শঙ্খ-করহুঁ দূর, ভূষণ করহুঁ চূড়, তোঁড়হি গজ-মতি হায় রে। শিখাঁক সিন্দুর, মুছিয়া করহ দূর, পিয়া বিনা সকলই আঁধার রে”—ইহাই তাঁহার ভাষা। তখন তাঁহার ভাব-সম্মেলনের “সখি আজি সুখের নাহিক ওর, চিরদিন মাধব মন্দিরে মোর” প্রভৃতি গান বৈষ্ণবদের জপমন্ত্র হইল, চৈতন্যদেব সারারাত্রি গাম্ভীরায় স্বরূপের সঙ্গে এই সকল গান গাইয়া প্রেমের অপূর্ব্ব আস্বাদ পাইতেন।