চণ্ডীদাস একটি পদে বলিয়াছন, কৃষ্ণরূপের ধাঁধায় পড়িয়া আমার দেহ-মন একেবারে আত্ম-বিস্মৃত হয়, তখন চক্ষুর দৃষ্টি বর্ণ-বৈষম্য ভূলিয়া যায়, তিনি কৃষ্ণবর্ণ অথবা গৌর-বর্ণ, তাহা আমি বুঝিতে পারি না। (“দেখিতে দেখিতে না চিনিয়ে কাল কিম্বা গোরা”)। কেহ কেহ এই পদটিতে গৌর আগমনের সূচনা বুঝিয়াছেন, এবং কেহ কেহ আবার তজ্জন্য উহা প্রক্ষিপ্ত মনে করিয়াছেন, কিন্তু কথাটা এরূপভাবে লিখিত হইয়াছে যে, তাহাতে স্পষ্ট ইঙ্গিত কিছুই নাই। কথাগুলি প্রক্ষিপ্ত হইলে, প্রক্ষেপকারী এরূপ অস্পষ্ট ইঙ্গিত দিতেন না, স্পষ্ট করিয়া বলিয়া ফেলিতেন। বহু পুরাণে বৈষ্ণবেরা চৈতন্য-আগমনের ভবিষ্যৎবাণীসূচক শ্লোক প্রক্ষেপ করিয়াছেন, তাহার সকলগুলিই স্পষ্ট সরল কথা, তাহাতে দ্ব্যর্থ কিছু নাই। কিন্তু চণ্ডীদাসের আর একটি পদে ইঙ্গিতটা স্পষ্টতর—“আজু কে গো মুরলী বাজায়—এতো কভু নহে শ্যাম-রায়—ইহার গৌর বরণে করে আলো”—এখানে গৌরাঙ্গের কথা কিছুই নাই; রাধা মুরলী-শিক্ষা উপলক্ষে কৃষ্ণের বেশ-ভূষা চাহিয়া নিজে পরিয়াছেন “তুমি লহ মোর নীল শাড়ী, তব পীত ধটা দেহ পরি” (বৃন্দা), চণ্ডীদাস এই রূপের কথাই বলিয়াছেন, সুতরাং কথাটা সহজেই বোঝা গেল। কিন্তু এই সুদীর্ঘ পদটির শেষ-দুই পংক্তি গূঢ় অর্থ-ব্যঞ্জক—“চণ্ডীদাস মনে মনে হাসে, এরূপ হইবে কোন দেশে?” এই গৌর মূর্ত্তির আর্বিভাব কোন্ দেশে হইবে, তাহা জিজ্ঞাসা করিয়া কবি মুখ টিপিয়া হাসিতেছেন, অর্থাৎ গৌরাঙ্গ যে আসিতেছেন, তাহার আভাস তিনি মনে মনে পাইয়া হৃষ্ট হইয়াছেন। এবার সমালোচকদের কেহ কেহ জোর গলায় বলিতেছেন, এই পদ প্রক্ষিপ্ত না হইয়া যায় না। কিন্তু ইংরাজীতে একটা কথা আছে, “Coming events cast their shadows before”, ভল্টেয়ার ও রসো যে-সকল কথা বলিয়াছিলেন, কিছু পরে নেপোলিয়ান সেইসকল কথার মূর্ত্তরূপে
পাতা:পদাবলী-মাধুর্য্য.djvu/১৫৮
এই পাতাটিকে বৈধকরণ করা হয়েছে। পাতাটিতে কোনো প্রকার ভুল পেলে তা ঠিক করুন বা জানান।
১৫২
পদাবলী-মাধুর্য্য