অলৌকিক প্লাবনে মনে হইত, তাহার সঙ্গীত-বিদ্যার কোন নিয়মের দিকে সে দৃক্পাত করে না, অথচ সে যেদিকে একটু হাতের ইঙ্গিত করিয়াছে, কি পা বাড়াইয়াছে, সেইদিকেই তাল-মান রাজার হুকুমে নফরের ন্যায় ছুটিয়া গিয়াছে। আখরগুলি তাহার হৃদয়োচ্ছ্বাস হইতে শত শত স্বর্ণপদ্মের ন্যায় ফুটিয়া উঠিয়াছে এবং তাহার সাবলীল কণ্ঠের বিলাপময় আলাপের পাছে রাগ-রাগিণী পতি-বিরহিতা স্ত্রীর ন্যায় পাগল হইয়া ছুটিতেছে। আমি এরূপ কীর্ত্তন আর শুনি নাই, তাহার ৪।৫ ঘণ্টার কীর্ত্তন এক নিমেষের মত কোথা দিয়া চলিয়া গিয়াছে, তাহা বুঝিতে পারিতাম না। গৌরদাস সত্য সত্যই এই পৃথিবীতে স্বর্গরাজ্য স্থাপন করিবার শক্তি রাখিত। গোষ্ঠ গাহিতে গাহিতে সে প্রারম্ভে কৃষ্ণসখাদের যশোদার আঙ্গিনায় আনিয়া উপস্থিত করিত, সে যখন “গগনে হইল বেলা যত শিশু হয়ে মেলা রে—উপনীত নন্দের ভবনে” “কিবা বেণু-বীণা-বাঁশী রব, করয়ে রাখাল সব” গাহিত, তখন যেন আকাশ-পটে চিত্রিত সুরঞ্জিত প্রভাত দৃশ্যকে সকলের প্রত্যক্ষে উপনীত করিত। ইহার পরে “আওত সুদামচন্দ রঙ্গিয়া পাগড়ী মাখে” গাহিয়া সর্ব্বপ্রথম সুদামকে উপস্থিত করাইত। সে রূপ-বর্ণনা অপূর্ব্ব! সুদামের মাথার পগ্গ কৃষ্ণপ্রেমের আবেশে বারে বারে খসিয়া পড়িতেছে,—“পগ লটপটি শিরে”, তাহার গলায় মতির হারের সঙ্গে “গো-বাঁধন দড়ি” ঝুলিতেছে—“স্ফূট চম্পকদল নিন্দিত” তাহার বর্ণ। তৎপর অপরাপর সখার বর্ণনা, তাহাদের প্রত্যেকের ভিন্ন ভিন্ন রূপ, ভিন্ন ভিন্ন বেশভূষা—“যার মা যেমন সাজায়েছে”, কিন্তু তাহারা সকলে এক ডুরিতে বাঁধা, তাহা কৃষ্ণপ্রেমের ডুরি। চিত্রের পুত্তলীয় ন্যায় তাহারা একে একে নন্দের ভবনে উপস্থিত হইয়া দাদা বলাই-এর আগমন প্রতীক্ষা করিতেছে। সুবলের সঙ্গে কৃষ্ণের অনেক তর্ক-বিতর্ক হইয়া গিয়াছে। সুবল বলিতেছে, “এই বৃন্দাবনে তো সকলেরই মা আছেন,
পাতা:পদাবলী-মাধুর্য্য.djvu/৪২
এই পাতাটিকে বৈধকরণ করা হয়েছে। পাতাটিতে কোনো প্রকার ভুল পেলে তা ঠিক করুন বা জানান।
৩৬
পদাবলী-মাধুর্য্য