সখারা যখন বিপন্ন তখনও তাহারা পরম বিশ্বাসে কৃষ্ণের মুখের দিকেই চাহিয়া আছে, তাহাদের বিপদের জ্ঞান নাই, প্রেমের বলে তাহারা নির্ভয় হইয়া গিয়াছে, “আনন্দং ব্রহ্মণো বেত্তা না বিভেতি কদাচন।” অপোগণ্ড শিশু মায়ের কাঁধে মাথা রাখিয়া দুর্গম পথে চলিয়াছে, চারিদিকে ব্যাঘ্রগর্জ্জন, আকাশে কৃষ্ণদৈত্যের মত রাশি রাশি মেঘের ভ্রুকুটী, শিশু নিশ্চিন্ত, সে কোন ভয়ই পাইতেছে না, ভয়-ভাবনা সমস্ত তাহার মায়ের, মাতৃক্রোড়ের দুর্গ আশ্রয় করিয়া সে প্রেমের জোরে নির্ভয়—সখারা কৃষ্ণ-প্রেমে সেইরূপ নির্ভয়, তাহারা কংস-চরের ভয় রাখে না।
গৌরদাসের কীর্ত্তন যে অপূর্ব্ব বৈকুণ্ঠ রচনা করিত, তাহাতে কিছুকালের জন্য আমি পার্থিব সমস্ত কথা ভুলিয়া যাইতাম, তাহাতে বৃন্দাবন-লীলাচ্ছলে ভাগবত তত্ত্ব এমনিভাবে প্রকটিত হইত। চৈতন্য-চরিতামৃত প্রভৃতি গ্রন্থেরও পদাবলীর যে সকল স্থানের অর্থ আমি বহুকাল হাতড়াইয়া পাই নাই, এই মূর্খ কীর্ত্তনীয়ার গান তাহা আমাকে স্পষ্টভাবে বুঝাইয়া দিত। গান করিবার সময়ে যেন সে ভাগবত উদ্যানের একটি ভাবকল্পবৃক্ষের মত হইয়া যাইত, তাহার আখরে ও হন্তের ভঙ্গীতে যে লীলার কথা ফুটিয়া উঠিত, সেরূপ মূর্ত্ত মহাকাব্য–দিব্য সঙ্গীত আমি আর কখনও শুনি নাই। অন্য দেশ হইলে, এই গৌরদাসের জন্য কত কি না হইত। সে কথা বলিয়া কাজ নাই। কিন্তু বিলাতের অনুকরণে আমরা জীবন-চরিত-সাহিত্যের সৃষ্টি করিয়া যাহাদের গুণকীর্ত্তন করিয়া বড় বড় গ্রন্থ লিখিতেছি ও নব নব সৌধ নির্ম্মাণ করিতেছি, তাঁহাদের মধ্যে কয় জন যে গৌরদাসের গা ঘেঁষিয়া দাঁড়াইতে পারেন, তাহা বলিতে পারি না। তবে বহু সরসীতে শতদল পদ্ম ও বনান্তে মল্লিকা, কুন্দ ও মালতী ফুটিয়া অনাদরে শুকাইয়া ঝরিয়া পড়ে, তাই বলিয়া তাহাদের