যিনি চক্ষুর পলকে আমায় হারাইতেন, তিনি এই যুগ-যুগ-ব্যাপী কাল আমাকে কিরূপে ভুলিয়া রহিলেন? তাঁহার ভালবাসা যেমন অসীম, নিষ্ঠুরতাও তেমনই অসীম। আজ আনন্দের দিনে সেই কথার উল্লেখের অবকাশ নাই। যেটুকু পাওয়া গিয়াছে, তাহার তিলমাত্র রসবিঘ্নকর কথার এখন অবকাশ নাই।
‘‘নেত্রপলকে যে নিন্দে বিধাতাকে,
এত ব্যাজে দেখা সাজে কি তাহাকে?
যাহৌক দেখা হ’ল, দুঃখ দূরে গেল,
এখন গত কথার আর নাই প্রয়োজন।”
এই ‘ভাব-সম্মেলনে’ কৃষ্ণের নিকট রাধা সম্পূর্ণরূপে আত্মসমর্পণ করিয়াছেন। হৃদয়ের অর্গল বন্ধ করিয়া, তিনি মনোমন্দিরে একান্তে তাঁহাকে পাইয়া, যে-সকল মধুর কথা তাঁহাকে বলিয়াছেন, তাহা বৈদিক যাজ্ঞিকের হোমকুণ্ডের পার্শ্বে উচ্চারিত উপনিষদের মন্ত্র। “বধূ, তুমি আমার প্রাণ-স্বরূপ। আমি শুধু দেহ-মন নহি, আমার সমন্ত কুলশীল, অভিমান ও সংস্কার আজ তোমাকে সঁপিয়া দিলাম। তুমি অখিল ব্রাহ্মাণ্ডের অধিপতি, তা’ কি আমি জানি না। আমি তুচ্ছ গয়লার মেয়ে—“আহিয়িনী, কুরূপিণী, গ্রাম্য গোপবালিকা।” এই ইন্দ্রিয়-রূপ পশুগুলিকে পরিচর্য্যা করাই আমার কাজ, “আমরা সকলেই পশুপালিকা” “আমরা কৃষ্ণসেবার কিবা জানি?” তুমি যোগী ঋষির আরাধ্য—“যোগীজনাঃ জানন্তি”, আমি ভজন পূজনের কিবা জানি? কিন্তু আমার দেহ-মন সমস্তই তোমার প্রেম গঙ্গায় ভাসাইয়া দিয়াছি। তোমার পদচ্যুতা গঙ্গার ধারাটি শ্মশান সমান উষর মরুভূমিতে পথ হারাইয়া তোমার পদাশ্রয়ে ফিরিয়া আসিয়াছে। পড়শীরা আমাকে নাম ধরিয়া ডাকিতে ঘৃণা করে। তারা আমাকে ‘কলঙ্কিনী’ বলিয়া ডাকে। কিন্তু তাহাতে আমার দুঃখ নাই।