পাতা:পদ্মানদীর মাঝি - মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়.pdf/১০২

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
১০২
পদ্মানদীর মাঝি

 হ, এ ফন্দি মন্দ নয়। দোলের উৎসবে মামাবাড়ি যাইবে ছেলেরা। একা তাে যাইতে পারিবে না তারা, কুবের তাই সঙ্গে যাইবে। কেহ টেরও পাইবে না কিসে কুবেরকে টানিয়া আনিয়াছে চরডাঙাতে!

 মালা বলিল, আগাে, নিয়া যাইবা ত আমারেও নিয়া চল।

 কুবের বলিল, না, তরে নিমু না। যাবি না কইলি ক্যান?

 কুবের বাঁচিয়াছে। মালাকে লইয়া চরড়াঙা যাওয়া কি সহজ কথা! রাজি না হইয়া ভালােই করিয়াছে মালা, যাতায়াতের ডুলিভাড়াটা কুবেরের বাঁচিয়া গেল।

 মালা এখন যাইতে চায়। ছেলেদের লইয়া কুবের যদি সত্যসত্যই যায় চরডাঙা তবে আর সে যাইবে না কেন? কুবের তার ইচ্ছা অনিচ্ছার কথা তুলিয়াছিল বলিয়াই না প্রথমটা সে রাজি হয় নাই? মালা স্বামীর তোষামােদ আরম্ভ করে। রাত্রে খানিক রাগারাগি কাঁদাকাটা করিতেও ছাড়ে না। কিন্তু কুবের অটল। যাইবে না বলিল কেন মালা? কুবের যখন তােষামােদ আরম্ভ করিয়াছিল বাহাদুরি করিয়া তখন যাইতে অস্বীকার করিল কেন? মরিয়া গেলেও কুবের তাে তাকে চরডাঙায় লইবে না! হ, কুবেরের গোঁ মালা জানে না। কী ভাবিয়াছে সে কুবেরকে?

 রাত্রি থাকিতে উঠিয়া লখা ও চণ্ডীকে টানিয়া তুলিয়া কুবের রওনা হইয়া গেল। মাথা কপাল কুটিয়া যাওয়ার জন্য কাঁদিতে লাগিল মালা, কুবের ফিরিয়াও তাকাইল না। সকাল-সকাল তাহারা পৌঁছিল চরডাঙায়। হাঁটিতে হাঁটিতে ছেলে দুটার পা ব্যথা হইয়া গিয়াছে। চণ্ডীকে মাঝে মাঝে কোলে করিয়া চলিতে হওয়ায় কুবেরের ধরিয়া গিয়াছে হাঁপ। শ্বশুড়বাড়ির দাওয়ায় বসিয়া গামছা দিয়া সে ঘাম মুছিতে লাগিল। একটু পরে কপিলা একখানা পাখা আনিয়া দিল। কুবের খুশি হইয়া বলিল, আছস কিবা কপিলা?

 কিবা দ্যাখ?

 কাহিল য্যান লাগে তরে।

 হ, কাহিল হইছি।

 কুবের ব্যগ্রকণ্ঠে জিজ্ঞাসা করে, ক্যান রে কপিলা, অসুখ নি করছে তর?

 নভার অসুখ মাঝি, তােমার লাইগা ভাইবা ভাইবা কাহিল হইছি।

 বলিতে বলিতে আঁচলের আড়াল হইতে হাত বাহির করিয়া এক ভাঁড় চুন-হলুদ কপিলা কুবেরের গায়ে ঢালিয়া দেয়। হাসিয়া গলিয়া পড়ে কপিলা। কুবের মূঢ়ের মতাে চাহিয়া থাকে। আনন্দ অথবা দুঃখ কিসে তাহার রােমাঞ্চ হয় সে বুঝিতে পারে না। কেতুপুরে থাকিবার সময় এমনিভাবে হাসিত কপিলা। আকুরটাকুরে শ্যামাদাসের বাড়িতে এ হাসির আভাসও কপিলার মুখে সে দেখিতে পায় নাই।

 কপিলার হাসির শব্দে বৈকুণ্ঠ বাহিরে আসে। লখা ও চণ্ডীকে সঙ্গে করিয়া কপিল চলিয়া যায় ভিতরে।

 শ্যামাদাসের কাছে বৈকুণ্ঠ ময়নাদ্বীপের কথা শুনিয়াছে। সে সেই কথা আরম্ভ করিল। কথায় কুবেরের মন ছিল না, সে অন্যমনে বৈকুণ্ঠের কথার জবাব দিয়া গেল।