পাতা:পদ্মানদীর মাঝি - মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়.pdf/১৬

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
১৬
পদ্মানদীর মাঝি

হারাধনকে জড়াইয়া ধরিবার চেষ্টা করিয়াছিল। তখন যে লম্বা কাঠের গুঁড়িটি হাতের কাছে আগাইয়া আসিয়া তাহাদের বাঁচাইয়া দিয়াছিল, হয়তাে তাহা চিতা রচনার জন্যই কেহ শ্মশানে আনিয়াছিল। হারাধন কিন্তু কাঠটি ফেলিয়া দিতে পারে নাই, ঘরের আসবাবে পরিণত করিয়া সাদরে গৃহে স্থান দিয়াছে।

 কুবেরের পিসি আর তার বড় মেয়ে গােপি কুবেরকে দেখিয়াই চেঁচামেচি করিয়া কাছে আসিয়াছিল। কুবের কারও সঙ্গে কথা বলিল না। লম্বা হইয়া পিসির বিছানায় শুইয়া পড়িল।

 পিসি বলিল, শুলি যে ধন? বউ ওদিকে পােলা বিয়াইয়া সারছে, দেইখা আয়।

 গােপি বলিল, বাই উ ওই বাবুগাের পােলার নাখান ধলা হইছে বাবা। নকুইলার মাইয়া পাচী কী কইয়া গেল শুনবা? সায়েবগাে এমন হয় না। না পিসি?

 কুবের চেঁচাইয়া ধমক দিয়া বলিল, নকুইলা কী লাে হারামজাদি? জ্যাঠা কইবার পার না?

 গােপি মুখ ভার করিয়া বলিল, ক্যান কমু জ্যাঠা? বজ্জাতটা আমারে যা মুখে লয় কয় না?

 কী কয়?

 রাইত কইরা মাইজাবাবু নি আমাগাের বাড়ি আহে তাই জিগায়। ইবার জিগাইলে একদল পাঁক দিমুনে ছুঁইড়া মুখের মধ্যে।

 দিস, বলিয়া কুবের ঝিমাইতে থাকে। খানিক পরেও ঘরের দাওয়া হইতে শিশুর জোরালাে কান্না শুনিতে পাওয়া যায়। মনে হয় ছেলেটা আগেভাগে আসিয়া পড়িলেও গলায় রীতিমতো জোর করিয়া আসিয়াছে। চেচাঁইতে পারে।


 কয়েকদিন পরে ছিল রথ।

 রথ উপলক্ষে কেতুপুরে কোনােরকম ধুমধাম হয় না। পদ্মার ওপারে আছে সােনাখালি গ্রাম, রথের উৎসব হয় সেইখানে। সােনাখালির জমিদারের ছােটো একটি রথ বাহির হয়। সােনাখালি হইতে মােহনপুর অবধি দশ মাইল লম্বা একটি উঁচু পথ আছে। বর্ষাকালে এই পথটিই এ অঞ্চলে জলের নীচে ডুবিয়া যায় না। পথটির নাম ছ-কোশের পথ। নামের মধ্যে পথটির এক ক্রোশ দৈর্ঘ্য কেমন করিয়া বাড়িয়া গিয়াছে বলা যায় না। সােনাখালির জমিদারদের রথ এই পথ ধরিয়া আধ মাইল খানেক গিয়া অন্নবাবার মাঠের একপাশে থামিয়া থাকে সাতদিন, তারপর উলটারথের দিনে আবার রওনা হয় জমিদারবাড়ির দিকে। স্থানটির অন্নবাবার মাঠ নাম হওয়ার একটু ইতিহাস আছে। অনেকদিন আগে এ অঞ্চলে একবার ভয়ানক দুর্ভিক্ষ হয়। সে সময় কোথা হইতে এক সন্ন্যাসী আসিয়া এই মাঠে আস্তানা গাড়েন এবং একটি বিরাট অন্নসত্র খুলিয়া দেন। নিজের বলিতে সন্ন্যাসীর এক কানাকড়ি