পাতা:পদ্মানদীর মাঝি - মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়.pdf/১৭

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
পদ্মানদীর মাঝি
১৭

সম্বলও ছিল না। শােনা যায়, এমনই আশ্চর্য ছিল মানুষের উপর তাঁহার প্রভাব যে সামনে দাঁড়াইয়া চোখে চোখে চাহিয়া তিনি হুকুম দিতেন আর বড়াে বড়াে জমিদার মহাজনেরা মনে মনে চাল ডাল পাঠাইয়া দিত এই মাঠে। শত শত ভদ্র গৃহস্থ নিজেরাই কোমর বাঁধিয়া তাহা রান্না করিয়া দুর্ভিক্ষপীড়িত নরনারীদের বিতরণ করিত অন্ন। ব্যাপারটা যে ঠিক এইরকমই ঘটিয়াছিল তার কোনাে প্রমাণ এখন আর নাই। যেসব বড়াে বড়াে উনানে সেই বিরাট ক্ষুধা-যজ্ঞের আগুন জ্বলিত আজ তাহার একটু কালির দাগ পর্যন্ত কোথাও খুঁজিয়া পাওয়া যাইবে না।

 রথের দিন এই মাঠে প্রকাণ্ড মেলা বসে, উলটারথ পর্যন্ত স্থায়ী হয়। পদ্মা আগে তফাতে ছিল, এখন এত কাছে সরিয়া আসিয়াছে যে মেলার একটা প্রান্ত প্রায় নদীতীরেই আসিয়া ঠেকে। স্থলপথ ও জলপথে দল বাঁধিয়া আসিয়া মানুষ মেলায় ভিড় বাড়ায়। ভিড় বেশি হয় প্রথম এবং শেষ দিন, মাঝখানের কদিন মেলা একটু ঝিমাইয়া যায়। গ্রামবাসীর প্রয়ােজনীয় ও শখের পণ্য সমস্তই মেলায় আমদানি হয়, এমনকি শহরের নারী-পণ্যের আবির্ভাবও ঘটিয়া থাকে। কাপড়ের দোকান, মনােহারি দোকান, মাটির খেলনার দোকান, খাবারের দোকান, দোকান যে কত বসে তার সংখ্যা নাই। গােরু-ছাগল বিক্রয় হয়, কাঁটাল ও আনারসে মেলার একটা দিক ছাইয়া যায়, বড়াে বড়াে নৌকায় মালদহ ও ত্রিহুতের আম আসে। লেমােনেডের নামে বােতলে ভরা স্যাকারিনের লাল নিস্তেজ জল বিক্রয় হয় অজস্র। মেয়েরা সাধ মিটাইয়া শাঁখা ও কাচের চুড়ি পরে, ছেলেদের কোমরে বাঁধিয়া দেয় নূতন ঘুনসি। কয়েকটি স্থানে গবর্নমেট হইতে লাইসেন্সপ্রাপ্ত জুয়াখেলা চলে। মেলার এটা একটি প্রধান অঙ্গ। সবচেয়ে বেশি ভিড় হয় বালা খেলার কাছে। চারকোনা বাঁশের বেড়ার চারিদিকে ভিড় করিয়া দাঁড়াইয়া চার-চার পয়সায় চার-চার বালা কিনিয়া বেশির ভাগ গরিব চাষাভুষারাই হরদম ছুঁড়িতে থাকে, রুদ্ধনিশ্বাসে চাহিয়া দেখে নিক্ষিপ্ত বালা ক-টি লাল শালুতে সাজানাে টাকা আধুলি সিকি ও দোয়ানির অরণ্যে অন্ধের মতাে ঘুরিয়া ঘুরিয়া স্থির হইতেছে ফাঁকা জায়গায়। পুনরাবর্তিত ব্যর্থতায় তাহাদের কোনােমতে যেন বিশ্বাস হইতে চায় না। কত কাছাকাছি সাজানাে মুদ্রাগুলি, ফাঁকা জায়গাই যে কম! ওদের মধ্যে কে বুঝি বউয়ের জন্য একখানা পাছাপাড় শাড়ি, ছেলেমেয়েদের জন্য কিছু খেলনা ও খাবার এবং সংসারের জন্য কী সব জিনিস কিনিতে অনেক দিনের চেষ্টায় জমানাে ক-টা টাকা আনিয়াছিল, দ্যাখাে, সন্ধ্যার সময় দূরের মানুষ যখন বাড়ির দিকে শ্রান্ত পা বাড়াইয়াছে বেচারির কাছে বিড়ি কিনিবার পয়সাও নাই! আজীবন উপার্জন করিয়া সে পরকে খাওয়াইয়াছে, সে যে কী নিরীহ গৃহস্থ! কারও কথা না ভাবিয়া আজ সে এ কী করিয়া বসিল? একবেলা স্বাধীনভাবে স্বার্থপরতা করিবার সুযােগ পাইয়া নিজেকে সামলাইতে পারিল না?

 রথের দিন সকাল হইতে গুঁড়িগুঁড়ি বৃষ্টি নার্মিয়াছিল। বেলা বাড়িলে নিদ্রাতুর চোখ মিটমিট করিতে করিতে গণেশ কুবেরের বাড়ি আসিল।

 কুবের তখনও ঘুমাইতেছিল। গণেশ তাহাকে ডাকিয়া তুলিল। বলিল, চল্ কুবির, না-টা ঠিক কইরা থুইয়া আহি। আমারে ডাইকা আজান খুড়া নায় গিয়া বইয়া আছে।