পাতা:পদ্মানদীর মাঝি - মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়.pdf/১৯

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
পদ্মানদীর মাঝি
১৯

থাকিলেও বরং একটা ঘর অপবিত্র করিয়া ফেলা চলিত। দুখানা কুঁড়ে যার সম্বল তার স্ত্রী আর কোথায় সন্তানকে জন্ম দিবে? ভদ্রলােকেরা উঠানে অস্থায়ী টিনের ঘর তুলিয়া দেয়, চৌকির ব্যবস্থা করে। যারা আরও বেশি ভদ্রলােক তাদের থাকে শুকনাে খটখটে স্থায়ী আঁতুড়ঘর। কুবেরের তাে সে ক্ষমতা নাই। তার যতখানি সাধ্য সে তা করিয়াছে। ভালাে করিয়া বেড়া দিয়া বৃষ্টির ছাঁট আটকাইয়াছে, ঘর ছাইবার শনগুলি বিছানার তলে পাতিয়া দিয়াছে, দেবীগঞ্জের রেল কোম্পানির কয়লা চুরি করিয়া আগুনের ব্যবস্থা করিয়াছে। আর সে কী করিতে পারে?

 হঠাৎ এক মিনিটেরও কম সময় ব্যাপিয়া ঝুপঝুপ করিয়া জোরে বৃষ্টি হইয়া গেল। তারপর যেমন গুঁড়িগুঁড়ি বৃষ্টি পড়িতেছিল তেমনি পড়িতে লাগিল। গণেশ দরজার কাছে সরিয়া আসিয়া বলিল, যাবি না কুবির?

 কুবের বলিল, হ, ল যাই। আইচ্ছা তুই ক দেখি গণেশ, হীরুজ্যাঠার ঠাঁই দুগা ছন চামু নাকি? দিব না?

 গণেশ বলিল, হীরুজ্যাঠা ছন দিব? জ্যাঠারে তুই চিনস না কুবির, কাইলের কাণ্ড জানস? বিহানে ঘরে ফির‍্যা শুমু, বউ কয় চাল বাড়ন্ত। খাও আইঠা কলা, ভর রাইত জাইগা ঘুমের লাইগা দুই চক্ষু আঁধার দ্যাহে—চাল বাড়ন্ত! বউরে কইলাম, হীরুজ্যাঠার ঠাঁই দুগা চাল কর্জ আন্‌গা, দুপুরে গাঁয়ে গিয়া কিনা আনুম। কলি না পিত্যয় যাবি কুবির, বউরে জ্যাঠা ফিরাইয়া দিল। কয় কী, বিষ্যুদবার কর্জ দেওন মানা।

 কুবের সবিস্ময়ে বলিল, হ? তর নিজের জ্যাঠা না?

 নিজের জ্যাঠা বইলাই পিরিত য্যান বেশি কুবির। খালি নিবার পারে, দিবার পারে না।

 এই কথাগুলি বলিতে পারার মধ্যে গণেশের পক্ষে বিস্ময়কর বুদ্ধিমত্তার পরিচয় আছে। কবের শিরশ্চালনায় সায় দিয়া বলিল, আমার ঘরে পাঠালি না ক্যান বউরে?

 গণেশ যেমন বােকা, তেমনি সরল। সে বলিল, তুই চাল পাবি কনে?

 একথায় অপমান বােধ করিয়া কুবের উঠিল রাগিয়া।

 চাল পামু কনে! ক্যান, আমরা ভাত খাই না? গরিব বইলা দুগা চাল কর্জ না দেওনের মতাে গরিব আমি না, জাইনা থুইস!

 কুবের রাগে ও গণেশ লজ্জায় খানিকক্ষণ চুপ করিয়া রহিল। শেষে গণেশ আস্তে আস্তে বলিল, গােসা করলানি কুবিরদা?

 মাঝে মাঝে, কুবেরের রাগের সময়, ভীরু গণেশ তাহাকে সম্মান করিয়া তুমি সম্বোধন করে।

 করুম না! গাও জ্বালাইনা কথা কস যে! আজান খুড়া বইয়া আছে, ল যাই।

 কুবের উঠানে নামিয়া গেল। বৃষ্টিতে ভিজিয়া ভিজিয়া উঠানটা কাদা ও পিছল হইয়া আছে। গৃহাঙ্গনের এই নােংরা পচা পাঁকের চেয়ে নদীতীরের কাদা অনেক ভালাে। সেই কাদায় হাঁটু পর্যন্ত ডুবিয়া গেলেও যেন এরকম অস্বস্তি বােধ হয় না। বাড়ির পাঁকে পায়ে হাজা হয়, পাক ঘাঁটিয়া যাহার জীবিকা অর্জন করিতে হয়, সেই পাঁকের সংস্পর্শে তাহারও