পাতা:পদ্মানদীর মাঝি - মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়.pdf/২০

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
২০
পদ্মানদীর মাঝি

পা কুটকুট করে। আকস্মিক ক্রোধে কুবের ছেলেমানুষের মতাে উঠানে একটা লাথি মারিল। পায়ের পাতার একটা পরিষ্কার ছাপ মাত্র উঠানে পড়িল, আর কিছু হইল না।

 আঁতুড় হইতে ক্ষীণস্বরে মালা বলিল, আ গাে যাইও না, শুইনা যাও। চালা দিয়া নি ঘরে জল পড়ছে? ছনগুলা লইয়া যাও, বিছানার তলে ছন দেওন না দেওন সমান।

 মালার মুখে এমন নিঃস্বার্থ উক্তি প্রায় শােনা যায় না। কুবেরের মুগ্ধ হওয়া উচিত ছিল কিন্তু তার পরিবর্তে সে বিরক্ত হইয়াই বলিল, কিয়ের সমান! ছন না পাইতা ভিজা ভিতে শােওন যায়? রঙ্গ কইরা কাম নাই, চুপ মাইরা শুইয়া থাক। চালার লাইগা ছন লাগে, আইনা লমু।

 হােসেন মিয়া না কইছিল খড় দিব?

 হােসেন মিয়া কইলকাতা গেছে।

 মালা আপশোশ করিয়া বলিল, কবে গেল? আগে নি একবার কইলা! এক পয়হার। সুই আইনবার কইতাম—কইলকাতায় পয়হায় দশখান পাওন যায়।

 কলিকাতা হইতে মালা এক পয়সার ছুঁচ আনিতে দিত শুনিয়া কেহ হাসিল না। পিসি বরং মালার কথায় সায় দিয়াই কী যেন বলিল, ঠিক বােঝা গেল না। জবাব দিবার প্রয়ােজন ছিল না। কুবেরের পায়ের আঙুলের ফাঁকে হাজার ঘায়ে বিষাক্ত পাক কামড়াইতেছিল। সে নীরবে বাহির হইয়া গেল।

 নদীতীরে নৌকায় তাহাদের কাজ ছিল। খাওয়া-দাওয়ার পর নৌকা লইয়া তাহারা সােনাখালির মেলায় যাইবে। সঙ্গে ছেলেমেয়েরা থাকিবে, কেতুপুর ও আশেপাশের গ্রাম হইতে এমন যাত্রীও পাওয়ার সম্ভাবনা আছে যাহারা ভাড়া দিয়া মেলায় যাইবে। নৌকাটা একটু সাফ করিয়া একটা অস্থায়ী হােগলার ছই খাটাইয়া দেওয়া দরকার। নৌকার ছােটো পালটি মেরামত করিবার জন্য নামানাে হইয়াছিল, বাঁশের মাস্তুলে সেটিও আবার ঠিক করিয়া খাটাইতে হইবে। বর্ষাকালে বাতাস প্রায় সােনাখালির দিকেই বহিতে থাকে, গুমােট করিয়া সামান্য বাতাস যদি উঠে, পাল তুলিয়া মেলায় পৌঁছিতে আজ এক ঘণ্টা সময়ও লাগিবে না।

 নদীর ধারে পৌঁছিয়া তাহারা দেখিতে পাইল ছাতি মাথায় দিয়া হােসেন মিয়া দাঁড়াইয়া আছে। ঘর ছাইবার জন্য হােসেনের কাছে বিনামূল্যে কিছু শণ পাইরের সম্ভাবনা ছিল, তাহাকে দেখিয়া কুবেরের খুশি হওয়াই উচিত ছিল। তবু লােকটার আবির্ভাবে চিরদিন যে দুর্জ্ঞেয় আশঙ্কা তাহাকে অস্বস্তি বােধ করায় আজও সেই আশঙ্কাই হঠাৎ তাহাকে দাঁড় করাইয়া দিল। চুপিচুপি বলিল, হােসেন মিয়া রে গণেশ!

 তাই তাে দেহি!

একটু রহস্যময় লােক এই হােসেন মিয়া। বাড়ি তাহার নােয়াখালি অঞ্চলে। কয়েক বৎসর হইতে কেতুপুরে বাস করিতেছে। বয়স তাহার কত হইয়াছে চেহারা দেখিয়া অনুমান করা যায় না, পাকা চুলে সে কলপ দেয়, নুরে মেহেদি রং লাগায়, কানে আতর মাখানাে তুলা গুঁজিয়া রাখে। প্রথম যখন সে কেতুপুরে আসিয়াছিল পরনে ছিল একটা ছেঁড়া লুঙ্গি, মাথায় একঝাঁক রুক্ষ চুল—ঘষা দিলে গায়ে খড়ি উঠিত। জেলেপাড়ানিবাসী মুসলমান