পাতা:পদ্মানদীর মাঝি - মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়.pdf/২১

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
পদ্মানদীর মাঝি
২১

মাঝি জহরের বাড়িতে সে আশ্রয় লইয়াছিল, জহরের নৌকায় বইঠা বাহিত। আজ সে তাহার বেঁটে খাটো তৈলচিক্কণ শরীরটি আজানুলম্বিত পাতলা পাঞ্জাবিতে ঢাকিয়া রাখে, নিজের পানসিতে পদ্মায় পাড়ি দেয়। জমি-জায়গা কিনিয়া, ঘরবাড়ি তুলিয়া, পরম সুখেই সে দিন কাটাইতেছে। গত বছর নিকা করিয়া ঘরে আনিয়াছে দু-নম্বর স্ত্রীকে। এইসব সুখের ব্যবস্থা সে যে কী উপায়ে করিয়াছে গ্রামের লােক ঠিক অনুমান করিয়া উঠিতে পারে না। নিত্য নূতন উপায়ে সে অর্থোপার্জন করে। নৌকা লইয়া হয়তাে সে পদ্মায় মাছ ধরিতে গেল—গেল সে সত্যই, কারণ যাওয়াটা সকলেই দেখিতে পাইল, কিন্তু পদ্মার কোনখানে সে মাছ ধরিল, মাছ বিক্রিই বা করিল কোন বন্দরে, কারও তাহা চোখে পড়িল না। তাহার নৌকার মাঝিদের জিজ্ঞাসা করিয়া একটা গল্প মাত্র শােনা গেল যে, যে বন্দরে তাহারা মাছ বিক্রয় করিয়াছে সেখানে নৌকায় যাতায়াত করিতে নাকি সাত-আট দিন সময় লাগে। তারপর কয়েকদিন হয়তাে হােসেন গ্রামেই বসিয়া থাকে, একেবারে কিছুই করে না। হঠাৎ একদিন সে উধাও হইয়া যায়। পনেরাে দিন এক মাস আর তাহার দেখা মেলে না। আবির্ভাব তাহার ঘটে হঠাৎ, এবং কিছুদিন পরে দুশাে গােরু ছাগল চালান হইয়া যায় কলিকাতায়।

 বড়াে অমায়িক ব্যবহার হােসেনের। লালচে রঙের দাড়ির ফাঁকে সবসময়েই সে মিষ্টি করিয়া হাসে। যে শত্রু, যে তাহার ক্ষতি করে, শাস্তি সে তাহাকে নির্মমভাবেই দেয় কিন্তু তাহাকে কেহ কোনােদিন রাগ করিতে দেখিয়াছে বলিয়া স্মরণ করিতে পারে না। ধনী-দরিদ্র, ভদ্র অভদ্রের পার্থক্য তার কাছে নাই, সকলের সঙ্গে তার সমান মৃদু ও মিঠা কথা। মাঝে মাঝে এখনও সে জেলেপাড়ায় যাতায়াত করে, ভাঙা কুটিরের দাওয়ায় ছেঁড়া চাটাইয়ে বসিয়া দা কাটা কড়া তামাক টানে। সকলে চারিদিকে ঘিরিয়া বসিলে তার মুখ আনন্দে উজ্জ্বল হইয়া উঠে। এইসব অর্ধ উলঙ্গ নােংরা মানুষগুলির জন্য বুকে যেন তাহার ভালােবাসা আছে। উপরে উঠিয়া গিয়াও ইহাদের আকর্ষণে নিজেকে সে যেন টানিয়া নীচে নামাইয়া আনে। না, মনে মনে ইহা বিশ্বাস করে না জেলেপাড়ার কেহই; জীবনযুদ্ধে জয়-পরাজয়ের একেবারে মিলন-সীমান্তে তাহারা বাস করে, মিত্র তাহাদের কেহ নাই। তবে বিশ্বাস অবিশ্বাসের জন্য কিছু আসিয়া যায় না। হােসেন মিয়া হাসিমুখে একেবারে বাড়ির ভিতরে গিয়া জাঁকিয়া বসিয়া তাহার গােপন, গভীর ও দুর্জ্ঞেয় মতলব হাসিলের আয়ােজন আরম্ভ করিলেও জেলেপাড়ায় এমন কেহ নাই যে তাহাকে কিছু বলিতে পারে। বলিতে হয়তাে পারে। বলে না শুধু এইজন্যে যে বলা নিরর্থক। তাতে কোনাে লাভ হয়না। যা সে ঘটায় সমস্তই স্বাভাবিক ও অবশ্যম্ভাবী। অন্যথা করিবার জন্য বুক ঠুকিয়া দাঁড়াইলে কার কী লাভ হইবে? তার চেয়ে বর্ষাকালে ঘরের ফুটা চাল যদি একটু মেরামত হয়, উপবাসের সময় বিনা সুদে যদি কিছু কর্জ মেলে, তাই ঢের লাভ।

 হােসেন মিয়ার গােপন মতলবের দুটো একটার খবর যে জেলেপাড়ার লােকেরা রাখে না তা নয়। জেলেপড়ার তিনটি পরিবার উধাও হইয়া গিয়াছে। হােসেন মিয়া যে ছেলে বুড়াে স্ত্রী পুরুষ নির্বিশেষে এক একটি সমগ্র পরিবারকে কোথায় রাখিয়া আসিত প্রথমে