পাতা:পদ্মানদীর মাঝি - মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়.pdf/২৩

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
পদ্মানদীর মাঝি
২৩

ধুইতে কুবের একসময় চাহিয়া দেখিল, হােসেন চলিয়া গিয়াছে। চালার জন্য অবিলম্বে প্রয়ােজনীয় শণের কথাটা এতক্ষণে তাহার মনে পড়িয়াছে, হােসেনকে বলিয়া রাখিলে ভালাে হইত। লােকটা এই আছে, এই নাই। শণের জন্য কাল সকালে হয়তাে ওর বাড়ি গিয়া শুনিবে, রাতারাতি ও ঢাকায় পাড়ি দিয়াছে। কবে ফিরিবে? কে তাহা জানে!

 হােগলার ছাউনিটা বাতার সঙ্গে বাঁধিতে বাঁধিতে কুবের হঠাৎ সচকিত হইয়া বলিল, কে হাঁকে রে গণশা?

 বহুদূর নদীবক্ষ হইতে হাঁক আসিতেছিল, মানব কণ্ঠের একটানা একটা ক্ষীণ আওয়াজ। দুই কানের পিছনে হাত দিয়া হাঁক শুনিয়া উঠিয়া দাঁড়াইয়া কুবের সাড়া দিয়া উঠিল। এ এক ধরনের ভাষা, পূর্ববঙ্গের মাঝিশ্রেণির লােক ছাড়া এ ভাষা কেহ জানে না। এ ভাষায় কথা নাই, আছে শুধু তরঙ্গায়িত শব্দ। উন্মুক্ত প্রান্তরে, বিস্তৃত নদীবক্ষে এ শব্দ দূর হইতে দূরে চলিয়া যায়, ক্ষীণ হইতে ক্ষীণতর হইয়া আসে কিন্তু তরঙ্গের তারতম্য অবিকল থাকিয়া যায়। অস্ফুট গুঞ্জনের মতাে মৃদু হইয়াও যদি কানে আসিয়া লাগে, পদ্মানদীর মাঝি কান পাতিয়া শুনিয়া অর্থ বুঝিতে পারে। শব্দের দুর্লক্ষ্য উৎসের দিকে চাহিয়া সে বুক ভরিয়া বাতাস গ্রহণ করে। বাঁ হাত কানের পিছনে রাখিয়া, ডান হাতটি মুখের সম্মুখে আনিয়া সঞ্চালিত করিয়া উচ্চারিত একটানা আওয়াজে সে তরঙ্গের সৃষ্টি করে।

 ধনঞ্জয় মন দিয়া শােনে নাই। সে জিজ্ঞাসা করিল, কেডা? কী কয়?

 কুবের কহিল, আমাগাের রাসু।

 ধনঞ্জয় অবাক হইয়া গেল।

 বিন্দা মাঝির পােলা? কস কী কুবির! শুনছসনি ঠিক?

 রাসুর গলা চিনি না খুড়া? অখনি আইবাে, দেইখাে।

 ধনঞ্জয়ের বিস্ময় কমিতে চায় না। বহুদূরের নৌকাটির দিকে চাহিয়া সে বলিল, রাসু না হােসেন মিয়ার দ্বীপে গেছিল?

 হ।

 আইল কিবা?

 কুবের বিরক্ত হইয়া কহিল, কিবা কমু খুড়া? আহুক, জিগাইও। হােসেন মিয়া ছাইড়া দিবার পারে, ও নিজে পলাইয়া আইবার পারে, না জিগাইয়া নি কওয়ন যায়?

 খানিক পরে আবার হাঁক আসিল, এবার আরও স্পষ্ট। হাঁকের আওয়াজে যে একটি উৎসুক সুর ছিল তিনজনের কানেই তাহা ধরা পড়িল। গণেশ কুবেরের মুখের দিকে চাহিয়া কী বলিতে গিয়া হাঁ করিয়া কিছুই বলিল না। হাঁকের জবাব দিবার জন্য কুবের সুদীর্ঘ শ্বাস গ্রহণ করিল।


কিছুক্ষণ পরে একটা জীর্ণ পুরাতন নৌকা আসিয়া ভিড়িল পাশে। দুজন অচেনা মাঝি নৌকা বাহিয়া আসিয়াছে। ভিন গাঁয়ের নৌকা। নৌকার খােলটা কাঁটালে এমনভাবেই বােঝাই করা হইয়াছে যে নৌকার প্রান্তভাগ জলের উপর কয়েক ইঞ্চিমাত্র ভাসিয়া আছে। উপরে কোনােরকম আবরণ নাই, গুঁড়িগুঁড়ি বৃষ্টিতে মাঝি দুজন এবং রাসু তিনজনেই ভিজিয়া