পাতা:পদ্মানদীর মাঝি - মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়.pdf/২৪

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
২৪
পদ্মানদীর মাঝি

গিয়াছে। তাড়া দিয়া রাসুকে এ নৌকায় নামাইয়া দিয়া মাঝি দুজন বােধ হয় বিড়বিড় করিয়া তাহাকে গাল দিতে দিতেই তৎক্ষণাৎ আবার ঠেলা দিয়া নৌকার মুখ ফিরাইয়া বইঠা ধরিল। পদ্মানদীর চিরন্তন রীতি অনুসারে কুবের জিজ্ঞাসা করিল, কোন গাঁও থেইকা আইলা মাঝি, যাইবা কোয়ানে?

 জবাব দিবার রীতিও চিরন্তন। তাহারা সক্রোধে বলিল, সুলপী থেইকা আইলাম, যামু মেলায়।

 রাগের কারণটা তাহাদের সহজেই বােঝা যায়। সুলপী হইতে সােজাসুজি সােনাখালির মেলায় যাওয়ার বদলে রাসুকে এখানে পৌঁছাইয়া দিতে তাহাদের পদ্মা পার হইতে হইয়াছিল। প্রতিদানে রাসু যে তাহাদের কিছুই দিতে পারে নাই তাহাও অত্যন্ত সুস্পষ্ট। কিন্তু এ ক্রোধ তাহাদের ফলপ্রসু নয়—এ শুধু ক্রোধ। রাসুর মতাে দুরবস্থায় পড়িয়া আবার যখন কেহ তাহাদের পদ্মা পার করিয়া দিবার অনুরােধ জানাইবে এমনিভাবে রাগিয়া উঠিলেও সেই নিরুপায় মানুষটিকে তাহারা না বলিতে পারিবে না, বিনা প্রত্যাশায় বােঝাই নৌকা লইয়া তিন ক্রোশ অতিরিক্ত বইঠা বাহিবে। ইহা মহত্ব নয়, পরােপকার নয়—ইহা রীতি, অপরিহার্য নিয়ম। আশ্চর্য এই, এ নিয়ম পালন করিয়া ক্রুদ্ধ হইয়া উঠাও অনিয়ম নয়।

{{ফাঁক}নৌকায় পা দিয়া রাসু খানিকক্ষণ আড়ষ্ট হইয়া দাঁড়াইয়া রহিল। তারপর কুবেরকে জড়াইয়া ধরিয়া গদগদ কণ্ঠে বলিল, আমি আলাম গাে কুবিরদা।

 কন থে আলি রাসু?

 কই কুবিরদা, কই। তােমাগাে দেইখা মুখে রাও সরে না, কতকাল পরে ফিরা আলাম!

 কুবের ও গণেশ তাহার চোখে জল দেখিতে পাইল। ধনঞ্জয় পড়িয়াছিল তাহার পিছনে, সে উপস্থিত থাকিতে রাসু যে আসিয়া পৌঁছিয়াই কুবেরকে জড়াইয়া ধরিয়া আহ্লাদে ডগমগ হইয়া উঠিল ইহাতে মনে মনে সে ঈর্ষাতুর ও অসন্তুষ্ট হইয়া উঠিয়াছিল। রাসুর আবির্ভাবে উত্তেজনা তাহারও কম হয় নাই। তাহা গােপন করিয়া শান্ত উদাসভাবে সে বলিল, বয় রে রাসু, বয়।

 কুবেরকে ছাড়িয়া রাসু হােগলার নীচে নৌকার আধভেজা পাটাতনের উপর বসিয়া পড়িল। হাতের উলটা পিঠে চোখ মুছিয়া পরনের জীর্ণ বসনে ঘসিয়া হাতে লাগা অশ্রু পুঁছিয়া ফেলিল। তিন জোড়া চোখ চাহিয়া রহিল তাহার শীর্ণ কঙ্কালসার দেহটির দিকে। তিন বছর আগে হােসেন মিয়ার সঙ্গে সপরিবারে সে যখন ময়নাদ্বীপের উদ্দেশে যাত্রা করিয়াছিল দেহ তখন তাহার অবশ্য বিশেষ পরিপুষ্ট ছিল না। কিন্তু এমনভাবে ভাঙিয়াও সে পড়ে নাই। রাসুর মাথায় বড়াে বড়াে চুল জট বাঁধিয়া গিয়াছে, সর্বাঙ্গে অনেকগুলি ক্ষতের চিহ্ন, কয়েকটা ঘা এখনও ভালাে করিয়া শুকায় নাই। দুটি পা-ই তাহার হাঁটুর কাছ হইতে গােড়ালি পর্যন্ত ফোলা। গায়ের চামড়া যেন তাহার আলগা হইয়া শুকাইয়া শক্ত ও কালো হইয়া উঠিয়াছিল, এখন বৃষ্টির জলে ভিজিয়া ভিজা জুতার চামড়ার মতাে স্যাঁতসেঁতে দেখাইতেছে। একটু আগে বহুদুর হইতে অত জোরে হাঁক দিবার শক্তি সে কোথায় পাইয়াছিল ভাবিয়া কুবের অবাক হইয়া রহিল।

 রাসু ঝিমাইয়া পড়িতেছিল, ধনঞ্জয় জিজ্ঞাসা করিল, ময়নাদ্বীপ থেইকা আলি না রাসু?