পাতা:পদ্মানদীর মাঝি - মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়.pdf/২৭

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
পদ্মানদীর মাঝি
২৭

একরকম চুরিই করিয়াছে বলিতে হয়, কিন্তু তাতে কী? ভিক্ষা সিধু কারও কাছে চায় নাই, পয়সা সিধু কারও চুরি করে নাই।

 কুবেরের উঠানে দাঁড়াইয়া সিধু বলে, আমারে না নিয়া ফিরা আলি কুবির?

 দাওয়ায় ডিবরির আলােতে কুবের একটা কোঁচের লােহার শলাকাগুলি পরীক্ষা করিতেছিল, মুখ না তুলিয়াই বলে, তুমি না হীরু জ্যাঠার নায় আগেই ফির‍্যা আইলা?

 সিধু দাওয়ায় উঠিয়া যায়।

 তা আইলাম কুবির, তা আইলাম। রঙ্গ কইরা কইলাম, বােঝস না? কোঁচটা কিনা আনলি সন্দ করি। নিল কত?

 অষ্ট আনা।

 আট-দশ হাত লম্বা সরু তল্লা বাঁশের ডগায় দশ-বারােটি তীক্ষ্ণ লােহার শলাকা বসানাে মাছমারা যন্ত্রটি সিধুও গম্ভীর মুখে পরীক্ষা করিয়া দেখে। গােড়ার দিকটা ধরিয়া অন্ধকার উঠানে ছুঁড়িবার অভিনয় করিয়া বলে, ভার মন্দ না, জিতছস কুবির। কাল পরশুতক আমিও একটা কিনা লমু।

 সিধুর মতলব কুবের ঠিক বুঝিতে পারে না। কোঁচটি সে ঘরের মধ্যে কোনায় দাঁড় করাইয়া রাখিয়া আসে। বিকালে বৃষ্টি বন্ধ হইয়া গুমােট করিয়া আছে; আকাশে বিশেষ মেঘ নাই বটে কিন্তু কখন যে মেঘ ঘনাইয়া আসিয়া মুষলধারে বৃষ্টি নামিবে বলা যায় না। রাসুকে পীতম তাহার বাড়ি লইয়া গিয়াছে। এখন হয়তাে আবার তাকে ঘিরিয়া সভা বসিয়াছে সেখানে, নিজের নির্বাসনের কাহিনি বলিয়া রাসু সকলকে মুগ্ধ করিয়া রাখিয়াছে। অত্যন্ত ক্ষুধা না পাইলে কুবেরও সেখানে গিয়া বসিত। পিসি হঁড়িতে ভাত ফুটাইতেছে, না খাইয়া রাসুর রােমাঞ্চকর গল্পের লােভেও কোথাও যাওয়ার ক্ষমতা এখন তার নাই।

 সিধু বসিয়া বসিয়া বাজে কথা বলে, শিথিল ছাড়া ছাড়া তাহার ভাষা, অনির্দিষ্ট অবান্তর বিষয়বস্তু। কুবের আনমনে সায় দিয়া যায় হ।

 পেটে ক্ষুধার জ্বালা, মনে পীতম মাঝির বাড়ি যাওয়ার তাগিদ, বুড়া সিধুর বকবক শুনিতে শুনিতে বিরক্তির তাহার সীমা থাকে না।

 শেষে সিধু যেন প্রসঙ্গক্রমেই বলে, খাসির একটা মাথা আনলাম কুবির। মস্ত মাথাখান—মইষের মতাে দুটা শিং।

 নিল কত?

 শ্যাষ বেলায় সস্তা কিনলাম কুবির। পুরা পাঁচ আনা চাইয়া শ্যাষ ম্যাশ চোদ্দ পয়হায় দিল। মাইয়াটারে ব্যানুন রাঁইধবার কইলাম, তা কয়, ত্যাল মরিচ নাই, চালও নাকি বাড়ছে।

 সিধুর কথা শুনিবার সমস্ত আগ্রহ কুবের সহসা হারাইয়া ফেলে। পিসিকে সে জিজ্ঞাসা করে, ভাত হইল পিসি? একেবারে সে পিছন ফিরিয়া বসে সিধুর দিকে।

 ক্ষণকাল অপেক্ষা করিয়া সিধু উঠিয়া যায়। বাঁশের একটা টুকরিতে খাসির কোটা মাথাটা আনিয়া কুবেরের সামনে ধরিয়া বলে, দেখ কুবির, মিছা কই নাই। ঘাড়ের কাছে খাসা খানিক মাংস ছিল, এই দেখ—টুকরির কাছে মুখ লইয়া ঠাহর করিয়া করিয়া সিধু কয়েক