পাতা:পদ্মানদীর মাঝি - মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়.pdf/২৮

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
২৮
পদ্মানদীর মাঝি

টুকরা মাংস বাছিয়া কুবেরকে দেখায়। করুণ নয়নে কুবেরের মুখের দিকে চাহিয়া বলে, ত্যাল মরিচ দিয়া ব্যানুন যা হইব—অমর্ত। আমিনুদ্দির ঠাঁই প্যাজ রসুন মাইগা আইনা—

 আমারে দেখাও ক্যান? রাঁধগা ব্যানুন।

 সিধু এবার স্পষ্ট করিয়াই বলে, ত্যাল মরিচ আর একমুঠা চাল দে কুবির। তরেও দিমুনে ব্যানুন।

 কুবের সন্ধিগ্ধ হইয়া বলে, দিবানি নিয্যস?

 সিধু আহত হইয়া বলে, দিমু না? কস কী কুবির! তরে না দিয়া যামু কই?

 তেল মশলা এবং চাল লইয়া সিধু উঠিল। আঁতুড় হইতে মালা বলিল, বুড়া কী বজ্জাত! মাথার ভাগ দিব না আইঠা কলা দিব, দেইখাে। কুবের উদাসভাবে বলিল, না দেয় না দিব। আজ তাে শ্যাষ না, আরেক দিন আইলে মাইরা খেদাইয়া দিমু—আমার লগে চালাকি কইরা যাইব কই?

 ভাত নামিলে ইলিশ মাছ ভাজা আর লংকা-রক্তিম তরকারি দিয়া ফেনসমেত তপ্ত অন্নে কুবের মুহূর্তের মধ্যে পেট ভরাইয়া ফেলিল। গােপিকে খানিক পরে একটা বাটি লইয়া গিয়া সিধুর কাছ হইতে খাসির মাথার ব্যঞ্জন আনিতে বলিয়া সে বাহির হইয়া গেল।

 পীতম মাঝির বাড়ি জেলেপাড়ার একেবারে উত্তর সীমান্তে। গােয়ালের ভিতর দিয়া তাহার বাড়িতে ঢুকিতে হয়; গােয়ালের একদিকে বাঁধা থাকে দুটি শীর্ণ গােরু, অন্যদিকে থাকে পীতমের প্রসিদ্ধ বেড়া-জাল, এতবড়াে জাল কেতুপুরের আর কাহারও নাই। বাড়িতে উঠানের বালাই নাই, গােয়াল পার হইয়া ঢুকিতে হয় প্রকাণ্ড একটা ঘরে। দুপাশের ছােটো দুখানা ঘরে ঢুকিবার দরজাও এই ঘরের ভিতর দিয়া। কার্পণ্য ও বেড়া-জালটির মতাে বাড়ি করার এই খাপছাড়া ঢংও পীতমের কম প্রসিদ্ধ নয়, লােকে নাম দিয়াছে কয়েদখানা। ঘরের পিছনে খানিকটা ফাঁকা জায়গা, তারপরে একটা ডােবা। ডােবার ওদিকে বাঁশবনের পরে আর মানুষের বসতি নাই, বহুদুর বিস্তৃত শস্যখেত আষাঢ়ের গােড়াতেই এখন অর্ধেকের বেশি জলে ডুবিয়া গিয়াছে। বাঁশবনে জেলেপাড়ার প্রায় সকলেরই পরিচিত একজোড়া পাঁচ ফুট লম্বা গােখুরা সাপ বাস করে। ডােবায় থাকে কয়েকটি গােসাপ।

 বড়াে ঘরখানায় সভা রীতিমতােই বসিয়াছিল। ঘরে ঢুকিয়া কুবের অবাক হইয়া দেখিল, সভাপতি রাসু নয়, হােসেন মিয়া। পীতমের কাঠের সিন্দুকটার উপরে কাঁথা ভাঁজ করিয়া পাতিয়া হােসেনকে বসিতে দেওয়া হইয়াছে। রাসু মিশিয়া গিয়াছে একেবারে ভিড়ের মধ্যে। সকলের মুখেই একটা দারুণ অস্বস্তির ভাব, আড়চোখে সকলে হােসেন মিয়ার দিকে চাহিতেছে। এতগুলি লােকের নিশ্বাসে ঘরের আবদ্ধ বাতাস হইয়া উঠিয়াছে দূষিত, গরমে হােসেন মিয়ার কপালে বড়ো বড়াে ফোঁটায় জমিয়া আছে ঘাম। এদিক ওদিক চাহিয়া কুবের টুপ করিয়া সকলের পিছনে বসিয়া পড়িল। হোসেন মিয়া এখানে আসিয়া জুটিল কোথা হইতে? এত লােকের সামনে রাসুর সঙ্গে যখন তাহার মুখােমুখি হইয়া গিয়াছে, কী কাণ্ডটা আজ হয় দ্যাখাে!

 কুবের বিষাদ বােধ করে। আহা, এতবড়াে একটা কর্মঠ শক্তিশালী লােক, একগুঁয়ে