পাতা:পদ্মানদীর মাঝি - মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়.pdf/২৯

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
পদ্মানদীর মাঝি
২৯

সম্মানকামী লােক, কপালের ফেরে বড়াে জব্দ হইয়া গেল। রাসু তাহাকে একেবারে হাতেনাতে ধরাইয়া দিয়াছে সকলের কাছে। যে এত প্রতিপত্তি অর্জন করিয়াছিল, আজ বুঝি তার মুখ ফুটিয়া কথা বলিতেও বাধিতেছে। সােজাসুজি অপমান করিবার সাহস হয়তাে কাহারও হয় নাই কিন্তু কৌশলে নানাভাবে নানা ইঙ্গিতে কত লজ্জাই লােকটাকে সকলে না জানি এতক্ষণ দিয়াছে। কুবের এমনই মমতা বােধ করে যে সে ভাবিতে থাকে, পারিলে আজ সে হােসেন মিয়ার পক্ষই লইত। লােভ দেখাইয়া মিথ্যা আশ্বাস দিয়া হােসেন মিয়া যে রাসুর স্ত্রীপুত্রকে সুদূর ময়নাদ্বীপে লইয়া গিয়া হত্যা করিয়াছে, কোন্ যুক্তি দেখাইয়া তাহার এই কীর্তি সে সমর্থন করিত, কুবের তাহা জানে না। সে যাকে ভয় করে, এতলােকের সামনে তার মাথা হেঁট হইয়া যাওয়ায় মনে মনে সে শুধু ব্যথা পাইতেছিল। অন্ধ আবেগের সঙ্গে তার মনে হইতেছিল, যারা পঙ্গু অসহায় জীব, শক্তিকে লজ্জা দেওয়া তাদের পক্ষে ভালাে কথা নয়—মানুষের ধর্মবিরুদ্ধ এ কাজ।

 একথা কুবের জানে যে হােসেন মিয়ার বিচার করিয়া শাস্তি বিধানের কল্পনা জেলেপাড়ার এই সমবেত মাতব্বরেরা করিবে না। তবু আজ এই সমষ্টি বিচারকের ভঙ্গি গ্রহণ করিয়াছে। কী স্পষ্টভাবেই না হােসেন মিয়াকে অপমান করিতেছে সকলের বসিবার ভঙ্গি, চাহিবার ভঙ্গি, চুপ করিয়া থাকার ভঙ্গি!

 বিচলিত ও উত্তেজিত হইয়া এদিক ওদিক চাহিতে চাহিতে কুবের দেখিতে পাইল, জহর আমিনুদ্দি এবং আরও দুজন মুসলমান মাঝি অত্যন্ত গম্ভীরমুখে একদিকে বসিয়া আছে। ধরিতে গেলে এরাই কেতুপুরের মুসলমান মাঝির সমাজ, আরও দু-চারজন যারা আছে তারা একান্ত নগণ্য। এদের সংখ্যা পাঁচ-ছয় ঘরের বেশি হইবে না। জেলেপাড়ার পূর্বদিকে এদের একত্র সন্নিবেশিত বাড়িগুলিতে বেড়ার বাহুল্য দেখিয়া সহজেই চিনিতে পারা যায়। যতই জীর্ণ হইয়া আসুক, ছেঁড়া চট দিয়া সুপারি গাছের পাতা দিয়া মেরামত করিয়া বেড়াগুলিকে এরা খাড়া করিয়া রাখে। অথচ খুব যে কঠোরভাবে পর্দাপ্রথা মানিয়া চলে তা বলা যায় না। মেয়েদের বাহিরে না আসিলে চলে না। নদীতে জল আনিতে যাইতে হয়, পুরুষেরা কেহ বাড়ি না থাকিলে দোকানে সওদা আনিতে যাইতে হয়, বাড়ির আনাচেকানাচে লাউ কুমড়া ফলিলে, মুরগিতে ডিম পাড়িলে, গ্রামে গিয়া বেচিয়া আসিতে হয়। বেড়াগুলি পর্দা রাখে শুধু অন্দরের আর এমন বউ-ঝি বাড়িতে যদি কেহ থাকে যাহার বয়স খুব কাঁচা—তাহার। এরা এবং জেলেপাড়ার অ-মুসলমান অধিবাসীরা সদ্ভাবেই দিন কাটায়। ধর্ম যতই পৃথক তােক দিনযাপনের মধ্যে তাহাদের বিশেষ পার্থক্য নাই।সকলেই তাহারা সমভাবে ধর্মের চেয়ে এক বড়াে অধর্ম পালন করে—দারিদ্র‍্য! বিবাদ যদি কখনও বাধে, সে সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত বিবাদ, মিটিয়াও যায় অল্পেই। কুবেরের সঙ্গে সিধুর যে কারণে বিবাদ হয়, আমিনুদ্দির সঙ্গে জহরের যে কারণে বিবাদ হয়, কুবের আমিনুদ্দির বিবাদও হয় সেই কারণেই। খুব খানিকটা গালাগালি ও কিছু হাতাহাতি হইয়া মীমাংসা হইয়া যায়।

 মধ্যস্থতা হয়তাে করে জহর মাঝিই।

 বলে, কুবের বাই ছাড়ান দাও। আরে হােই আমিনুদ্দি, সামাল দে। পােলাপানের পারা কাইজা করস, তগর শরম নাই?