পাতা:পদ্মানদীর মাঝি - মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়.pdf/৪২

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
৪২
পদ্মানদীর মাঝি

এবার ধানের জমিতে পর্যন্ত পাটের চাষ দিয়াছিল, কে তাহাদের এমন সর্বনাশ করিয়াছে গাে।

 মাচা হইতে বৈকুণ্ঠ, চালা হইতে অধর, মই হইতে কপিলা আর সাঁকো হইতে উলঙ্গ ছেলেমেয়েগুলি নৌকায় আসিয়া আরাম করিয়া বসিল। কুবের তামাক সাজিয়া দিল বৈকুণ্ঠকে।

 কপিলা বলিল, নাও নিয়া আইলা মাঝি, বইনেরে আনলা না ক্যান? কতকাল দেখি নাই বইনেরে। পােলাপানগাে তাে আইনবার পারতা?

 কুবের বলিল, আনুম ভাবছিলাম। তােমরা এহানে কিবা রইছ না জাইনা শ্যাষম্যাশ ডরাইলাম। আসনের লাইগা গােপি কাঁইন্দা সারা হইছিল। তুমি আইলা কবে, কপিলা?

 কপিলা মুখভঙ্গি করিয়া বলিল, আমার কথা থোও।

 সহজ স্বাভাবিক প্রশ্নে কপিলার বিরক্তি দেখিয়া কুবের একটু অবাক হইয়া বৈকুণ্ঠের দিকে চাহিল। একমুখ ধোঁয়া ছাড়িয়া বৈকুণ্ঠ চোখ মটকাইয়া তাকে কী যেন একটা ইশারা করিল। কিছুই বুঝিতে না পারিয়া-কুবের করিল কী, মৃদু একটু হাসিয়া বলিল, অ!

 কপিলা রূঢ়স্বরে বলিল, হাসলা যে মাঝি?

 কুবের বলিল, হাসি নাই কপিলা, হাসুম ক্যান?

 কুবেরের বিবাহের সময় বড়াে দুরন্ত ছিল কপিলা। তখন পঙ্গু মালাকে বিবাহ করিয়াছিল বলিয়াই হয়তাে কপিলার দুরন্তপনা অত বেশি চোখে পড়িয়াছিল কুবেরের, অন্ধকারে যে বাস করে মৃদু আলােতে তার চোখ ঝলসাইয়া যায়, চোখ ঝলসানাে আলােতে সে হয় অন্ধ॥ তারপর কপিলার বিবাহ হইয়াছে, একটি মেয়ে হইয়া আঁতুড়ে মরিয়া গিয়াছে বছর দুই আগে। কে জানে কত শান্তশিষ্ট হইয়া উঠিয়াছে কপিলা আজকাল, কেমন সংসারী হইয়াছে তাহার মন? আর কি কোনােদিন সে গাছের ডালে কাঁচা বেতের দোলনা বাঁধিয়া দোল খাইবে, কিশাের বয়সের অপূর্ব দেহটিকে ঘাটের উপর হইতে ছুঁড়িয়া দিবে পুকুরের জলে, ডিঙি লইয়া একা একা পালাইয়া গিয়া সকলকে দিবে বকুনি দেওয়ার শাস্তি? রাগের মাথায় এ জীবনে আর কখনও হয়তাে সে কুবেরকে চ্যালা কাঠ ছুঁড়িয়া মারিবে। না মারুক। একজন চ্যালা কাঠ ছুঁড়িয়া মারিবে না বলিয়া আপশােশ করির কী আছে? খানিক পরে পাশাপাশি দুটি বাঁশের উপর দিয়া কপিলাকে ঘরের দিকে যাইতে দেখিয়া কুবেরের দুচোখ ঝাপসা হইয়া আসিল। হ, সেই পুরানাে দিনে স্মৃতি গাঁথা হইয়া আছে কুবেরের মনে।

 জল কমিয়া যাওয়া পর্যন্ত কেতুপুরে তাহার বাড়িতে গিয়া থাকিবার জন্য কুবের সকলকে নিমন্ত্রণ করিল। এ আহ্বান তুচ্ছ করিবার মতাে নয়, কিন্তু সকলে গেলে কেমন করিয়া চলে? বাড়িঘর জিনিসপত্র সব সাময়িকভাবে তুলিয়া লইয়া যাইতে পারিলে হইত, সে তাে সম্ভব নয়। বােবা গােরু-বাছুরগুলির কী হইবে? যাইতে পারে ছেলেমেয়েগুলি—আর তাদের দেখাশােনা করিবার জন্য কপিলা যদি যায় তাে যাক, মালা তাে পারিবে না এতগুলি কাচ্চা-বাচ্চাকে সামলাইতে।