পাতা:পদ্মানদীর মাঝি - মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়.pdf/৪৫

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
পদ্মানদীর মাঝি
৪৫

করে। তামাকের ভাগিদার না থাকার আরামটুকুই কি তাহার মানসিক চাঞ্চল্য ক্রমে ক্রমে শান্ত করিয়া আনে, অথবা সে নদীর বাতাস— নায়ের দোলনে পদ্মার প্রেম? মালা যে কোনােদিন ওঠে নাই, হাঁটে নাই, ঘুরিয়া বেড়াইয়া চারিদিকে জীবনকে ছড়াইয়া মেলিয়া রাখিতে পারে নাই, তার জন্য কুবেরের কোনােদিন আপশােশ ছিল না। গতি নাই বলিয়া মালার আবদ্ধ ঘনীভূত জীবন তারই বুকে উথলিয়া উঠিয়াছে—ভাঙা চালার নীচে সংকীর্ণ শয্যায় পঙ্গু মালার তুলনা জগতে নাই। কিন্তু অন্ধকার রাত্রে তামাক পৌঁছাইয়া দিতে সে তাে কোনােদিন নদীতীরে ছুটিয়া আসিতে পারে না—বাঁশের কঞ্চির মতাে অবাধ্য ভঙ্গিতে পারে না সােজা হইয়া দাঁড়াইতে!


বেগুনি রঙের শাড়িখানি পরিয়া চুলে চপচপে তেল দিয়া শুধু লীলাখেলা করিতেই কপিলা পটু নয়, কুবেরের সেবাও সে করে—জীবনে কুবের কখনও যে সেবার পরিচয় পায় নাই। সারারাত্রি পদ্মার বুকে কাটাইয়া আসিয়া এখন সে না চাহিতে পা ধােয়ার জল পায়, পান্তাভাতের কাঁসিটির জন্য হাঁকাহাঁকি করিতে হয় না, খাইয়া উঠিবামাত্র তামাক আসে, প্রস্তুত থাকে তাহার দীন মলিন শয্যা এবং ফাঁক পাইলেই কোনােদিন গোঁফ ধরিয়া টান দিয়া, কোনােদিন একটা চিমটি কাটিয়া, হাসি চাপিয়া চোখের পলকে উধাও হইয়া—ঘুম আসিবার আগেই কপিলা তাহাকে স্বপ্নও আনিয়া দেয়।

 পরের পেট ভরাইতে ফতুর হইতে বসিয়াও গৃহে তাই কুবেরের আকর্ষণ বাড়ে।

 কমে মাঠঘাটের জল।

 ও তো মানুষের চোখের জল নয়, কমিবে বইকী। একদিন মালার বড়াে ভাই অধর খবর লইতে আসে। কুবেরকে সে সত্যসত্যই কুবের ঠাওরাইয়া রাখিয়াছে কিনা সে-ই জানে, কর্জ চাহে দুটি টাকা। টাকা না পাইয়া তাহার রাগ হয়। সকলকে সে চরডাঙায় ফিরাইয়া লইয়া যাইতে চায়। কুবের বারণ করে না, মালাও নয়, ভাইবােনকে কাছে পাওয়ার আনন্দ পুরানাে হইয়া আসিতে কতদিন আর লাগে বােনের? তা ছাড়া কপিলার চাপল্য ও হাস্যপরিহাসের জন্য ঈর্ষাও হয়তাে মালার হয়, কোনােদিন হয়তাে কুবেরের সঙ্গে কপিলার অন্যায় মাখামাখি চোখেও পড়িয়াছে তাহার—একস্থানে ঠায় বসিয়া থাকিলেও দৃষ্টি তাে সে পাতিয়া রাখে সর্বত্র।

 কিন্তু কপিলা যায় না। ঝগড়া করিয়া গাল দিয়া অধরকে সে ভাগাইয়া দেয়। কে জানে কী আছে কপিলার মনে!


ময়নাদ্বীপ হইতে রাসুর আকস্মিক আবির্ভাবের বিস্ময় গ্রামের লােকের কাছে পুরানাে হইয়া গিয়াছে, রাসুর অভিজ্ঞতার গল্প শুনিবার কৌতুহল কাহারও নাই। রাসু বলিতে চায়, সবিস্তারে বারবার আগাগােড়া সমস্ত কাহিনিটা বলিবার জন্য সে ছটফট করে, কিন্তু শ্রোতা পায় না। কত শুনিবে লােকে? শুনিয়া শুনিয়া কান ঝালাপালা হইয়া গিয়াছে সকলের।

 হােসেন মিয়া কিছু টাকা দিয়াছে রাসুকে, রাসুর ইচ্ছা টাকাটা দিয়া সে একটি বউ খরিদ