পাতা:পদ্মানদীর মাঝি - মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়.pdf/৪৭

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
পদ্মানদীর মাঝি
৪৭

যাহাতে রাজি করানাে যায়? পরামর্শ অনেক হয়, উপায় হয় না। শীতলের অনুপস্থিতিতে তাহার পরিষ্কার শয্যায় আরাম করিয়া বসিয়া তাহার হুঁকায় তামাক টানিতে টানিতে পরামর্শ করিতে পারাটুকুই লাভ হয় রাসুর। আর যুগীর সমবেদনা। রাসুকে যুগী খুব খাতির-যত্ন করে, রাসুর মুখে ময়নাদ্বীপের কাহিনি বারবার শুনিয়াও সে শ্রান্ত হয় না। কত বাসিন্দা ময়নাদ্বীপে? কী কী ফসল হয়? দ্বীপের চারিদিকে বুঝি সমুদ্র? আচ্ছা, সমুদ্র কত বড়াে—পদ্মার চেয়েও বড়াে বুঝি? আজও যুগী রাসুকে এইসব প্রশ্ন করিতে ভালােবাসে। যুগীর বয়স বেশি নয়, বছর বাইশ—বড়াে শান্ত তাহার স্বভাব, বড়াে সরল তাহার মন। শীতল তাহাকে সুখে রাখিয়াছে, আড়াল করিয়া রাখিয়াছে জেলেপাড়ার দারিদ্র্য ও হীনতা হইতে। যুগীর মনে অপরিমিত সন্তোষ। এত দয়ামায়া, এমন কোমলতা জেলেপাড়ার আর কোনাে মেয়ের নাই। জেলেপাড়ার কারও ঘরে কোনােদিন যদি অন্ন না থাকে, চুপিচুপি একবার যুগীর কাছে আসিতে পারিলে আর তাহার উপবাসের ভয় থাকে না—দুঃখের কাহিনি যে যত জমজমাট করিয়া বলিতে পারে ছলছল চোখে যুগী তাহাকে চাল দেয় তত বেশি—খরচের পয়সা দান করিয়া শীতলের বকুনি শােনে। শীতল লােকটা বড়াে কৃপণ, যুগীর দান করা স্বভাবটা সে পছন্দ করে না কিন্তু এমন আশ্চর্য মন মানুষের, যুগীর এই মন্দ স্বভাবের জন্যই তাহাকে শীতল ভালােবাসে বেশি। যুগীকে সে কৃপণ হইতে বলে। কিন্তু সন্ধ্যার সময় বাড়ি ফিরিলে যুগী যেদিন ভয়ে ভয়ে তাহাকে শােনায় না যে একজন আসিয়া তাহার ঘাড় ভাঙিয়া যা পারিয়াছে আদায় করিয়া লইয়া গিয়াছে, সেদিন মনটা যেন খুঁতখুঁত করে শীতলের।

 মাছের মূল্য বাবদ কুবের কয়েক আনা পয়সা পাইত। শীতল কখনও ঋণ পরিশােধ করে না। তাগিদ করিয়া করিয়া কুবের হয়রান হইয়া গিয়াছে। তবু, একদিন সকালে আবার সে আশা করিয়া আসিল।

 যুগী রাঁধিতেছিল, শীতল আর রাসু করিতেছিল গল্প। কুবেরকে দেখিয়া রাসু চঞ্চল হইয়া উঠিল, বসিতে দিয়া খাতির করিয়া কলিকাটা বাড়াইয়া দিয়া বলিল, তামুক খাও।

 না, কুবেরের বসিবার সময় নাই, তামাক খাওয়ার সময় নাই! শীতল তাড়াতাড়ি পয়সাটা দিয়া দিক সে তাড়াতাড়ি চলিয়া যাইবে—বসিয়া তামাক টানিতে আসিয়াছে নাকি সে? হ, কুবের আজ রাগিয়াছে। আজ সে মাছের দাম আদায় করিয়া ছাড়িবে। শীতল প্রথমে অমায়িক হাসি হাসিয়া জিজ্ঞাসা করে, এত রাগ কেন কুবেরের, এই সকালবেলা? তারপর সেও রাগিয়া যায়, বলে, যা যা দিমু না পয়সা, কর গিয়া নালিশ।

 রাসু বুঝি কুবেরকে খুশি করতে চায়, সে বলিল, দ্যান শেতলবাবু, দিয়া দ্যান পয়সা।

 পয়সা দিল যুগী। কলহের মাঝখানে দশ আনা পয়সা আনিয়া কুবেরের সামনে রাখিয়া দিল, শীতলকে ধমক দিয়া বলিল, সামান্য ক-আনা পয়সার জন্য এত কাণ্ড করা কী জন্য? কত কর্তৃত্ব যুগীর! শীতল কথাটি বলিল না, কুবেরের দিকে কড়া চোখে চাহিয়া ঘরের ভিতরে চলিয়া গেল।

 পয়সা কুড়াইয়া কুবের উঠিল, সঙ্গে উঠিল রাসু। কী বিনয় রাসুর, কী সব তােষামােদে