পাতা:পদ্মানদীর মাঝি - মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়.pdf/৪৮

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
৪৮
পদ্মানদীর মাঝি

কথা! পথ চলিতে চলিতে রাসু নানা কথা বলে। এবার সে একটা ব্যাবসা আরম্ভ করিবে—ব্যাবসা ছাড়া পয়সা নাই মানুষের, একটা সে দোকান দিবে দেবীগঞ্জে। কিসের দোকান এখনও সে তা ঠিক করে নাই, ভাবিয়া চিন্তিয়া একটা কিছু ঠিক করিয়া লইবে—কুবের কী পরামর্শ দেয়? জীবনে উন্নতি করিবে রাসু, প্রাণপণ করিয়া লাগিলে কী না হয় জগতে? তা ছাড়া পুরুষের ভাগ্যের কথা কে জানে! আজ ফকির—কাল রাজা! কুবের গম্ভীর মুখে সায় দিয়া বলে, হ। ভাবে, ময়নাদ্বীপে গিয়া বড়াে বড়াে কথা বলিতে শিখিয়া আসিয়াছে রাসু, চাল দিতে শিখিয়াছে।

 মাঠের দিকে চাহিলে বােঝা যায় জল কোথায় নামিয়া গিয়াছে, ধানের ফসল কাত হইয়া পড়িয়া আছে। পদ্মা হইতে আজ জোর বাতাস বহিতেছিল, চারিদিকে অসংখ্য পাখির কলরব, শিশিরভেজা ডাঙায় ছড়াইয়া আছে সােনার রােদ, শরৎকাল আসিয়া পড়িয়াছে সন্দেহ নাই। নদীতীরে কাশের বন এবার সাদা হইয়া উঠিবে। কুবেরের সঙ্গে রাসু তাহার বাড়ি পর্যন্ত আগাইয়া যায়। না, গােপি এখন বাড়ি নাই। কপিলার সঙ্গে সে জল আনিতে গিয়াছে নদীতে। কুবের রাসুকে বসিতে বলে না, পিসির নিরিবিলি ঘরখানায় গিয়া ঢেকে ঘুমের জন্য, রাসু আস্তে আস্তে ফিরিয়া যায়। যায় সে নদীর ধারে, গাল সে খায় কপিলার, তারপর হনহন করিয়া হাঁটিতে আরম্ভ করে কেতুপুর গ্রামের দিকে। না, নদীর ধারে ওভাবে দাঁড়ানাে উচিত হয় নাই। কপিলা যদি বলিয়া দেয় কুবেরকে?


ভাদ্রের পরে আশ্বিন। আশ্বিনের মাঝামাঝি পূজা।

 একদিন প্রবল ঝড় হইয়া গেল। কালবৈশাখী কোথায় লাগে। সারাদিন টিপি টিপি বৃষ্টি হইল, সন্ধ্যায় আকাশ ভরিয়া আসিল নিবিড় কালাে মেঘ, মাঝরাত্রে শুরু হইল ঝড়। কী সে বেগ বাতাসের আর কী গর্জন! বড়াে বড়াে গাছ মড়মড় শব্দে মটকাইয়া গেল, জেলেপাড়ার অর্ধেক কুটিরের চালা খসিয়া আসিল, সমুদ্রের মতাে বিপুল ঢেউ তুলিয়া পদ্মা আছড়াইয়া পড়িতে লাগিল তীরে। জেলেপাড়ার বৃদ্ধ ও রমণীরা হাহাকার করিয়া রাত কাটাইল, ছেলেমেয়েরা কেহ ভয়ে নিস্পন্দ হইয়া রহিল, কেহ গুমরাইয়া গুমরাইয়া কাঁদিতে লাগিল। ইলিশের মরসুম শেষ হইলে মােটা উপার্জনের সুযোগ দুদিন পরে ফুরাইয়া যাইবে, জেলেপাড়ার কোনাে ঘরে আজ বুঝি সমর্থ দেহ পুরুষ নাই, পদ্মার বুকে নৌকা ভাসাইয়া ছড়াইয়া গিয়াছে দূর দূরান্তরে। কে ফিরিবে প্রভাতে, কে ফিরিবে না? ঝড় শুরু হইলে ঘরে ঘরে মেয়েরা উঠানে পিঁড়ি পাতিয়া দিয়াছে—ঝড়ের দেবতা বসিবেন, শান্ত হইবেন। ঘরে ঘরে মেয়েরা কপাল কুটিয়া মধুসূদনকে ডাকিয়াছে। এ কি রােষ দেবতার? কেন এ প্রলয়?

 সকালে ঝড় কমিল কিন্তু একেবারে থামিল না। সাঁ সাঁ শব্দে বাতাস বহিতে লাগিল, বৃষ্টি পড়িতে লাগিল গুঁড়িগুঁড়ি। জেলেপাড়ার দিকে তাকানাে যায় না, ঘন-সন্নিবিষ্ট