পাতা:পদ্মানদীর মাঝি - মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়.pdf/৫১

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
পদ্মানদীর মাঝি
৫১

 পায় বিষম চোট পাইছে মাইয়া। শুনছ নি বিত্তান্ত?

 কুবের মাথা হেলাইয়া বলিল, হ। ফুইলা গেছে না?

 বিষম ফুলছে! দিন ভইরা চিল্লাইয়া মরছে মাইয়া।

 চারিদিকে ভাঙা গাছ, ভাঙা ঘর, পত্রপল্লবে আচ্ছাদিত পথ, কুবেরের চোখে জল আসে। ঘরের কাছে গিয়া সে দাঁড়াইল। ঘর কই কুবেরের! ভাঙিয়া অঙ্গনে হুমড়ি খাইয়া পড়িয়াছে। পিসির ঘরে সকলে আশ্রয় লইয়াছিল। ঘরে ঢুকিয়া কুবের ঢেঁকিটার উপর বসিয়া পড়িল। গোপি শুইয়া শুইয়া কাতরাইতেছে। পায়ে তাহার চুন হলুদ মাখানাে হইয়াছে, হাঁটুর কাছে বেজায় ফুলিয়াছে। মালার চোখে ভীতি-বিহুল দৃষ্টি। গতরাত্রের প্রলয়ংকর কাণ্ড ভীরু পঙ্গু নারীটিকে আধমরা করিয়া রাখিয়া গিয়াছিল, এখনও সে সামলাইয়া উঠিতে পারে নাই। কুবের আসিয়া পড়াতে সে যেন স্বস্তির নিশ্বাস ফেলিয়া বাঁচিল।

 পিসি ভাত রাঁধিয়া রাখিয়াছিল। ঝড়বাদল ভূমিকম্প কিছুই পিসির ভাত রাঁধা বন্ধ করিতে পারে না। খানিক পরে উঠিয়া কুবের ভাত খাইল। তারপর গােপির কাছে একটু বসল। যন্ত্রণায় মেয়েটার মুখ নীল হইয়া গিয়াছে। কী করিবে কুবের, যন্ত্রণা লাঘবের কী মন্ত্র সে জানে, গােপিকে যাতে এতটুকু আরাম দিতে পারে? নীরবে চাহিয়া দেখা ছাড়া কোনাে উপায় নাই। মালা ধীরে ধীরে বলিতে থাকে মড়মড় করিয়া ঘর ভাঙিয়া পড়ার সময় আতঙ্কে দিশেহারা হইয়া ছুটিয়া বাহিরে যাওয়ায় কীভাবে গােপির উপর চালটা আসিয়া পড়িয়াছিল। ঘরে থাকিলে মেয়েটার কিছু হইত না। ঝড়ের সময় যে বাহিরে যাইতে নাই, ঘরের মধ্যে থাকাই সবচেয়ে নিরাপদ, সেটুকু বুদ্ধি তাে মেয়ের নাই। শুনিতে শুনিতে কুবের ঢুলিতে থাকে।

 হ, কুবেরের ঘুম পাইয়াছে। উন্মুক্ত নদীতীরে বসিয়া সে কাটাইয়াছে ঝড়ের রাত্রি, সকালে হাঁটিয়া আসিয়াছে দেবীগঞ্জে, দুটি মুড়ি শুধু সে খাইয়াছে, বাড়ি পৌছানাে পর্যন্ত দুর্ভাবনায় ঢিপঢিপ করিয়াছে বুকের মধ্যে। এখন পেট ভরিয়া খাইয়া উঠিয়া আর তাহার জাগিয়া থাকিবার ক্ষমতা নাই। মালার সব কথা তার কানে যায় না। গােপির মাথার কাছে সংকীর্ণ স্থানটুকুতে কোনােমতে কাত হইয়া সে একসময় ঘুমাইয়া পড়ে।

 সন্ধ্যার আগে জেলেপাড়ার সকলেই ফিরিয়া আসিল। পদ্মার গ্রাসে কেহ যায় নাই। পীতম মাঝির নৌকাটি শুধু মাঝ-নদীতে ঝড়ের মুখে পড়িয়া ডুবিয়া গিয়াছে। নৌকায় ছিল পীতমের ছেলে মাখন, কুবেরের প্রতিবেশী সিধু আর তার ভাই মুরারি—অর্ধমৃত অবস্থায় একটা চরে উঠিয়া রাত কাটাইয়া তাহারা ফিরিয়া আসিয়াছে, আর বলিয়া বেড়াইতেছে তাহাদের বাহাদুরির কাহিনি, পাহাড়-সমান ঢেউয়ের সঙ্গে লড়াই করিয়া কীভাবে তাহারা নিজেদের প্রাণ বাঁচাইয়াছিল।

 কয়েকটা দিন বড়াে গােলমালের মধ্যে কাটিয়া গেল। ধীরে ধীরে ভাঙা ঘরগুলির সংস্কারের চেষ্টা চলিতে লাগিল। কেতুপুরের দু-চারখানা ঘরবাড়ি পড়িয়া গিয়াছিল, একদিন মেজোকর্তা অনন্ত তালুকদারের সভাপতিত্বে গ্রামবাসীর এক সভা হইয়া গেল। ক্ষতিগ্রস্ত আর দুঃস্থদের জন্য চাঁদা তােলার ব্যবস্থা হইল। অনন্তবাবু নিজে দান করিলেন দশ টাকা,