পাতা:পদ্মানদীর মাঝি - মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়.pdf/৫৮

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
৫৮
পদ্মানদীর মাঝি

 গােসা কর ক্যান? উই দ্যাখ জাহাজ আহে।

 সেইখানে নদীতীরে দাঁড়াইয়া তাহারা চাহিয়া থাকে, চক্রাকারে পাক দিয়া জাহাজ আসিয়া ভিড়ে জেটিতে। কী ভিড় হইয়াছে আজ জাহাজে! আজ পূজা শেষ, আজও দেশ-দেশান্তরের মানুষ গৃহে ফিরিতেছে। আর, কী অদৃষ্ট কুবেরের, মেয়েটাকে আজ এই বিদেশে হাসপাতালে ফেলিয়া রাখিয়া মূঢ়ের মতাে সে দাঁড়াইয়া আছে নদীতীরে, কোথায় যাইবে কী করিবে ঠিক নাই! ভোঁ দিয়া জাহাজ ছাড়িয়া যায়। নদীর আলােড়িত জল ঢেউ তুলিয়া তীরে আছড়াইয়া পড়ে। মেয়েটার জন্য এমনই ঢেউ উঠিয়াছে কুবেরের বুকে।

 হঠাৎ কপিলা বলিল, মাঝি, পয়সাকড়ি আনছ?

 হ।

 কত?

 তা দিয়া কী কাম তর?

 আমি কিছু আনছি, লাগলে নিও।

 কপিলা আঁচলে গেরাে বাঁধা পয়সা দেখাইল।

 কুবের হাঁ না কিছুই বলিল না। জেটি নির্জন হইয়াছে দেখিয়া খানিক পরে জেটিতে গিয়া ছায়ায় তাহারা বসিয়া রহিল। কুবের তাকায় না কপিলার দিকে, একটার পর একটা বিড়ি ধরাইয়া টানিতে থাকে—মিনিটে মিনিটে বিড়ি খাওয়ার মতােই সে যেন বড়ােলােক।

 ক্যামনে ফিরবা মাঝি? খানিক পরে কপিলা জিজ্ঞাসা করিল।

 কেডা জানে? যেমন কাণ্ড তর কপিলা। তরে নিয়া কী যে করুম—

 আমার লাইগা ভাইবাে না মাঝি।

 এতক্ষণে কী মনে করিয়া কুবের হাসিল, বড়াে পােলাপান তুই কপিলা। সোয়ামি শুইনা কী কইব তর ভাবছস নি?

 কউক।

 তা বইকী। কলঙ্ক কিনিবার সাধ যে কপিলার ষােলাে আনা দেখা যায়? কুবের গম্ভীরভাবে মাথা নাড়ে। এ তাে ভালাে কথা নয়। একবাড়িতে যারা বাস করে শুধু দুর্নাম কিনিবার জন্য এখানে তাদের পড়িয়া থাকিবার কোনাে মানে হয় না। শুধু গােপির জন্যই কি কপিলা রহিয়া গেল? গােপিকে সে এত ভালােভাসে? কে জানে, কপিলার মন বুঝিবার ক্ষমতা ভগবান কুবেরকে দেন নাই।

 বেলা পড়িয়া আসিলে দুজনে হাসপাতালে গেল। কুবেরের এবার প্রথম মনে হইল থাকিয়া বুঝি ভালাে করিয়াছে কপিলা। এমন করিয়া নতুবা গােপিকে সে নিজে তাে সান্ত্বনা দিতে পারিত না কপিলার মতাে! তা ছাড়া যে কাণ্ড আজ ডাক্তার করিলেন গােপিকে লইয়া, কপিলা না থাকিলে বুক বাঁধিয়া সেসময় কে থাকিত গােপির কাছে? গােপির হাঁটুর হাড়ই শুধু ভাঙে নাই, মস্ত একটা বাঁশের গোঁজ ঢুকিয়া গিয়াছিল মাংসের মধ্যে, পা ফুলিয়া সেটাকে আড়াল করিয়া ফেলিয়াছে। ডাক্তার এ বেলা সেটা টানিয়া বাহির করিলেন, তারপর ভাঙা হাড়টা যতদূর সম্ভব স্বস্থানে বসাইয়া কোমরের কাছ হইতে পা পর্যন্ত কাঠের তক্তা