পাতা:পদ্মানদীর মাঝি - মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়.pdf/৫৯

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
পদ্মানদীর মাঝি
৫৯

বসাইয়া বাঁধিয়া দিলেন ব্যাণ্ডেজ। কুবের এসব দেখিল না, বাহিরে বসিয়া সে শুধু গােপির আর্তনাদ শুনিল।

 দুজনে যখন তাহারা হাসপাতাল হইতে পথে নামিয়া আসিল, সন্ধ্যা হইতে বেশি বাকি নাই। দূরে বিসর্জনের বাজনা বাজিতেছিল। গ্রামেই এখন তাহাদের ফিরিতে হইবে। এখানে রাত কাটাইবে কোথায়? কাল আবার কুবের আসিয়া গােপিকে দেখিয়া যাইবে। নদীর ঘাটে গিয়া কুবের নৌকায় নৌকায় চেনা মাঝি খুঁজিয়া বেড়াইল। চেনা মাঝি দু-চারজন মিলিল বটে কিন্তু আজ বিজয়ার সন্ধ্যায় নৌকা তাে কেহ খুলিবে না! দেবীগঞ্জের দিকে যাদের যাওয়ার দরকার ছিল, দিনে দিনে তারা চলিয়া গিয়াছে। তবে গহনার নৌকা[১] ছাড়িবে একটা, কুবের ইচ্ছা করিলে ভাড়া দিয়া যাইতে পারে। নতুবা কাল সকাল পর্যন্ত অপেক্ষা করুক, যে নৌকাই কেতুপুরের দিকে যাক, কুবের তাহাতে গ্রামে ফিরিতে পারিবে।

 কত নাও যাইবাে কাইল, পয়সা দিয়া ক্যান যাইবা কুবের বাই? বলিয়া পরিচিত মাঝি কুবেরকে নৌকায় রাত্রি যাপন করিতে অনুরােধ করে। শুধু পরিচিত মাঝি কেন, পদ্মানদীর মাঝি সে, পদ্মানদীর যে-কোনাে মাঝির নৌকায় রাত্রিযাপনের অধিকার তার জন্মগত, কিন্তু এখানে রাত কাটানােই যে মুশকিল। কপিলার সঙ্গে একত্র এখানে রাত কাটাইয়া গিয়া কাল গ্রামে সে মুখ দেখাইবে কী করিয়া? কী বিপদেই কপিলা তাহাকে ফেলিয়াছে।

 পয়সা দিয়া গহনার নৌকায় যাওয়া ছাড়া উপায় নাই। কত ভাড়া লইবে কে জানে! জিজ্ঞাসা করিতে গহনার নৌকার মাঝি বলে, সােনাখালি হইয়া তীরে তীরে তাহারা দেবীগঞ্জ পৌছায়, পদ্মা পার হইয়া কুবেরকে কেতুপুরে তাহারা নামাইয়া দিতে পারিবে না। হাসাইলের খাল পর্যন্ত তাহারা এ তীর ঘেঁষিয়া চলিবে, কুবের সেখানে নামিতে পারে, ভাড়া মাথা পিছু তিন আনা।

 হাসাইলের খাল হইতে কেতুপুর দু-ক্রোশের কম নয়। এই রাত্রে অতখানি পথ কপিলা হাঁটিতে পারিবে কিনা সন্দেহ। কুবের জিজ্ঞাসা করে, কী করি কপিলা?

 কপিলা বলে, না গেলাম আইজ? কাইল বিয়ানে গােপির দেইখা মেলা করুম?

 থাকুম কই? নায়?

 তাই কি হয়! ডাকাত না গুণ্ডা নৌকার মাঝি কে জানে, কপিলা কী পারে এই নদীর ঘাটে খােলা নৌকায় শুইয়া থাকিতে? ওই তাে ঘাটের হােটেল দেখা যায়, ওখানে একটা ঘর ভাড়া নেওয়া যাক।

 কী আর করিবে কুবের, দরদস্তুর করিয়া ছ-আনায় বড়ো একটা ঘরের একদিকে ছাঁচের বেড়ায় ঘেরা স্থানটুকু ভাড়া করে। দরজা বা ঝাঁপ কিছুই নাই, ঢুকিবার জন্য একটু ফাঁক রাখিয়া ঘেরিয়া দিয়াছে। ঘরের মধ্যে সারি সারি মােটা পাটি পাতা, অতিথির রাত্রে শয়ন করিবে—ঘেরা স্থানটুকুর মধ্যে একখানা পাটিতেই মেঝের প্রায় সবটা ভরিয়া গিয়াছে। বাহিরে খােলা চালার নীচে খাওয়ার জায়গা, রান্নাঘরেও কতকগুলি পিঁড়ি


  1. গহনার নৌকা—প্রত্যহ নিয়মিত সময়ে ছাড়িয়া বহুদূর অবধি যাত্রী লইয়া যাওয়া আসা করে।