পাতা:পদ্মানদীর মাঝি - মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়.pdf/৬৫

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
পদ্মানদীর মাঝি
৬৫

লাগানাে হইল ভাড়া খাটিবার কাজে। ছেলেরা মাছ ধরিবে, নিজে সে একজন মাঝিকে লইয়া নৌকা বাহিবে।

 কুবেরকে ধনঞ্জয় পছন্দ করে না। গণেশকে সে তার নৌকার মাঝি হইতে বলিল। কিন্তু গণেশ কিনা বােকা, সে গেল পরামর্শ জিজ্ঞাসা করিতে কুবেরের কাছে!

 কুবের রাগিয়া বলিল, যা যা, খাট গিয়া আজান খুড়ার নায়। আমারে জিগাস ক্যান? আজান খুড়া বেশি আপনার না তর?

 কুবের অনুমােদন না করিলে তাহা হইবার নয়। গণেশ ধনঞ্জয়কে বলিয়া আসিল তার নৌকায় একা সে মাঝির কাজ করিবে না, কুবের যদি করে তবেই সে করিবে, নতুবা নয়। শুনিয়া ধনঞ্জয় বলিল, যা মর গিয়া তবে। পঞ্চাশজনা মাঝি রাখুম, কলের জাহাজ পাইছস, না?

 গণেশ তাহা জানে না। চিরদিন সে কুবেরের কথায় নির্ভর করিয়া আসিয়াছে, কলের জাহাজ হােক আর ছােটো পানসি হােক, কুবের যেখানে নাই গণেশও নাই সেখানে। কুবেরের দাওয়ায় বসিয়া সে নিশ্চিন্ত মনে তামাক টানিতে লাগিল, আর কুবের গম্ভীর চিন্তিত মুখে ভাবিতে লাগিল, এবার কী করিবে। মাঝিগিরিই সে করিবে সন্দেহ নাই, তবু গম্ভীর চিন্তিত মুখে অন্য কিছু করা যায় কিনা ভাবিতে কুবের চিরদিন বড়াে ভালােবাসে। কপিলা চলিয়া যাওয়ার পর ক্রমে ক্রমে কুবেরের অভাব বাড়িয়াছে। ঘরের লক্ষ্মী যেন চলিয়া গিয়াছে কপিলার সঙ্গে, পরিপূর্ণভাবে ক্ষুধার নিবৃত্তি আর হইতেছে না। সময়টা পর্যন্ত পড়িয়াছে খারাপ। জিনিসপত্রের দাম চড়িয়া গিয়াছে। বর্ষায় একটা ফসল নষ্ট হইয়াছিল, পাটের কল্যাণে আমন ধানের ফসলও হইয়াছে কম। চাষিদের ঘরে ধান নাই, টাকা নাই, আছে পাট-কুবেরের ঘরে কিছুই নাই। পাটের উপর চাষির অনিশ্চিত মরণ বাঁচন, কুবেরের জীবনধারণ সুনিশ্চিত মাঝিগিরিতে—সেটা ভালােমতাে জুটিতেছে না। একটা নৌকা যদি কুবেরের থাকিত! পদ্মার ঘাটে ঘাটে তবে সে কুড়াইয়া বেড়াইতে পারিত জীবিকা, পরের নৌকায় লগি ঠেলিতে পাইবার ভরসায় বসিয়া থাকিতে হইত না।

 ভােরবেলা এখন নদীর বুক জুড়িয়া থাকে কার্তিকের কুয়াশা, যদিও অগ্রহায়ণ আসিয়া গিয়াছে। জলের তল হইতে মাঠঘাট মাথা তুলিয়াছে। কোথাও রবিশস্যের চারা উঁকি দিয়াছে, কোথাও সবে শস্য-বীজ বপন করা হইতেছে। রাত্রে অল্প অল্প শীত করে, কাপড় গায়ে দিতে হয়।

 কুবেরের মন বড়াে খারাপ। কিছু ভালাে লাগে না। গোপি হাসপাতাল হইতে ফিরিয়া আসিয়াছে, ভাঙা হাঁটুটি তাহার শক্ত হইয়া গিয়াচ্ছে। সে হাঁটিতে পারে না। ভবিষ্যতে আবার কোথায় হাড় ভাঙিয়া ঠিক করিয়া দিলে খোঁড়াইয়া খোঁড়াইয়া হয়তাে সে হাঁটিতে পারিবে, চলন তার স্বাভাবিক হইবে না কোনােদিন। যুগলকে জামাই করার আশা আর নাই। মেয়ের বিবাহ দিবার এবং সে উপলক্ষে কিছু টাকা পাইবার ভরসাও লুপ্ত হইয়া গিয়াছে।