পাতা:পদ্মানদীর মাঝি - মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়.pdf/৬৭

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
পদ্মানদীর মাঝি
৬৭

দুটা চোখ, একটা খড়ের পুঁটুলির উপর ভাঙা পা-টি রাখিয়া এলাইয়া পড়িয়া আছে বিছানায়।

 রাসু মমতা বােধ করে। ময়নাদ্বীপে একে একে স্ত্রীপুত্রকে হারাইয়া যে নিষ্ঠুর বেদনায় বুক তাহার দীর্ণ হইয়া গিয়াছিল, তেমন বেদনা লক্ষ স্ত্রীপুত্রকে হারাইয়াও আর সে কোনােদিন অনুভব করিবে না—গােপির ভাঙা পা-খানা দেখিলে মনটা শুধু কেমন করিয়া ওঠে।


একদিন সকালে হােসেন মিয়া কুবেরের বাড়ি আসিল।

 মৃদু মৃদু হাসিয়া জিজ্ঞাসা করিল, কাম মিলে নাই কুবের বাই?

 কুবের মাথা নাড়িয়া বলিল, না।

 হােসেন বলিল, জান দিয়া তােমাগাে দরদ করি, ক্যামনে ভালা করুম তোমাগাে হুঁশ থুই কুবের বাই। কাম করবা, আমার লায়?

 মনে মনে কুবের ভয় পাইল। কী মতলব করিয়াছে হােসেন মিয়া? যাচিয়া কাজ দিতে চায় কেন? হােসেন মিয়ার উপকার গ্রহণ করিলে শেষ পর্যন্ত মঙ্গল নাই কুবের তাহা ভালাে করিয়াই জানে, কোন স্বার্থ সাধিবার জন্য কবে কাকে হােসেন মিয়ার প্রয়ােজন হয় তাই শুধু কেহ জানিতে পারে না। কুবের একবার ভাবিল, না, হােসেন মিয়ার নৌকায় সে কাজ করিবে না। কিন্তু একথা বলা যায় না। লােকটার মৃদু হাসি-ভরা মুখের দিকে চাহিয়া যত ভয় করে কুবেরের, সেই ভয়ের তাড়নাতে ওকেই যেন জড়াইয়া ধরিবার প্রয়ােজন তত বাড়ে। তা ছাড়া, আজ পর্যন্ত ক্ষতি সে কিছুই তাহার করে নাই, বরং উপকার করিয়াছে অনেক।

 কুবের জোর করিয়া আগ্রহ দেখাইয়া বলিল, হােসেন মিয়ার নৌকায় কাজ পাইলে সে বর্তিয়া যায়। সে যেন জানিত না কুবের রাজি হইবে, এমনিভাবে হােসেন খুশি হইয়া গেল—মানুষ বশ করার কত কায়দাই লােকটা জানে! কী কাজ করিতে হইবে কুবেরকে, কী সে পাইবে এসব কথা কিছুই উঠিল না। হােসেন শুধু বলিল, মাঝে মাঝে দশ পনেরাে দিনের জন্য কুবেরকে বাড়িঘর ছাড়িয়া যাইতে হইবে, যাইতে হইবে পদ্মার দূরতম বন্দরে, যেখানে যেখানে হােসেন মিয়ার বাণিজ্য আছে। কিসের বাণিজ্য হোসেন মিয়ার? কে তা জানে! কে সে প্রশ্ন করিবে? কুবের শুধু সায় দিয়া গেল—তার আপত্তি নাই। সপরিবারে ময়নাদ্বীপ যাওয়া ছাড়া যেখানে যাইতে বলুক, কুবের সেইখানে যাইবে, যা করিতে বলুক তাই করিবে, প্রতিদানে জীবিকা পাইলেই হইল।

 গণেশের কথাটা কুবেরের মনে পড়িতেছিল, তার জন্য ধনঞ্জয়ের নৌকায় একা সে কাজ নেয় নাই। আজ গণেশকে ফেলিয়া হােসেন মিয়ার নৌকায় কাজ নেওয়া তার কি উচিত হইবে? কুবের উশখুশ করে। গণেশের কথাটা বলিতে গিয়া মুখে আটকাইয়া যায়। বন্ধুত্ব বজায় রাখিতে গিয়া যদি তার নিজের কাজটা ফসকাইয়া যায়? তা ছাড়া তার সঙ্গে