বাড়ির পথে গণেশের সঙ্গে কুবের কথা বলিল না। বড়াে সে চটিয়াছে গণেশের উপর। গণেশ সঙ্গে সঙ্গে চলে, একথা সেকথা বলে, কুবের নীরব হইয়া থাকে, মুখ ফিরাইয়া চাহিয়াও দেখে না। গণেশের কিনা মােটা বুদ্ধি, কুবের যে রাগিয়াছে এটা সে টের পাইল একেবারে বাড়ির কাছাকাছি গিয়া।
টের পাইবামাত্র সে বিবর্ণ হইয়া বলিল, গােসা করছ নাকি কুবিরদা?
কুবের বলিল, যা যা বাড়িত্ যা, বাজে বকস ক্যান?
বলিয়া সে হনহন করিয়া আগাইয়া গেল। গণেশ ক্ষুধার তাড়নায় তখনকার মতাে বাড়ি গেল বটে, ভাতটি খাইয়াই সে আবার হাজির হইল কুবেরের বাড়িতে। কুবের কথা কয় না, চাহিয়াও দেখে না। গণেশ ভাবিয়া চিন্তিয়া তামাক সাজিয়া নিজে দুটো একটা টান দিয়াই কুবেরের দিকে বাড়াইয়া দিল, বলিল, ধর কুবিরদা।
কুবের হুঁকা গ্রহণ করিল। তবু সে কথা বলিল না!
বিপদে পড়িয়া গণেশ প্রায় কাঁদো কাঁদো হইয়া বলিল, কিবা কর কুবিরদা, আঁই? যামু গিয়া কইলাম, আর আমু না!
তখন তাহাকে ক্ষমা করিয়া কুবের জিজ্ঞাসা করিল, কাইল রাইতে ছিলি কই?
প্রশ্ন শুনিয়াই গণেশ হাসিয়া ফেলিল, ফিসফিস করিয়া বলিল, বাক্যা মাইয়া কুবিরদা, কিবা গীত কয়!
বলিয়া সে গুনগুন করিয়া গান ধরিল
পিরিত কইরা জ্বইলা মলাম সই, আ লাে সই!
আওন যাওন সমান সােনার, জউলা চুকা দৈ!
আ লাে সই।
থাকলি’ ঘরে ছ্যাঁচন কেমন, চেঁকির তলে চিড়া যেমন,
বিদেশ গেলি, মনের পােড়ন ভাইজা করে খৈ!
আ লাে সই!
কুবের বলিল, দুর দুর লক্ষ্মীছাড়া! কুচরিত্তির হইছস, আঁই? ক্যান গেছিলি?
গণেশ প্রতিবাদ করিয়া বলিল, কুচরিত্তির কিবা? গীত শােননে দোষ নাই।
ঠিক বেড়ার আড়ালে মালা বুঝি শুনিতেছিল, ডাকিয়া বলিল, আবার কও গীতখান—শুনছ মাঝি? আবার কও।
কুবের ধমক দিয়া বলিল, চুপ থাক, গীত শুইনা কাম নাই।
খানিক পরে চাঁদপুর যাত্রার কথা উঠিল। আড়াল ছাড়িয়া হাতের ভরে ঘষিয়া ঘষিয়া মালা এবার আসিল কাছে। মুসলমান পরিবারটিকে হােসেন মিয়া কোথায় লইয়া যাইবে অনুমান করিতে কারাে বাকি থাকে নাই, কে জানে কোন গ্রাম হইতে ওদের হােসেন সংগ্রহ করিয়া আনিয়াছে! কেহ কুপরামর্শ দিবে ভাবিয়া নৌকা হইতে ওদের সে গ্রামে নামিতে পর্যন্ত দেয় নাই। মানুষটি সহজ নয় হােসেন মিয়া! মরুক, তাদের কী? তারা