পাতা:পদ্মানদীর মাঝি - মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়.pdf/৭৪

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
৭৪
পদ্মানদীর মাঝি

ভিতরের পরিবারটিকে। কী মনমরাই ওদের দেখাইতেছে সকালবেলার ম্লান আলােকে! কারও মুখে কথা নাই, কী যেন ভাবিতেছে সকলে, ভীত ও স্তব্ধ ছেলেমেয়েগুলির পর্যন্ত এতটুকু সাড়া নাই জীবনের! গ্রাম ছাড়িয়া দেশ ছাড়িয়া নিরুদ্দেশ যাত্রার গভীর বিষাদ ওদের আচ্ছন্ন করিয়া দিয়াছে।

 খানিক দেখিয়া কুবের পুরুষটিকে জিজ্ঞাসা করিল, নাম কি মিয়া?

 সে মৃদুস্বরে বলিল, রসুল।

 বাড়ি কই?

 মালুর চর।

 কথা বলিতে তাহার ভালাে লাগিতেছে না বুঝিতে পারিয়া কুবের চুপ করিয়া গেল। হােসেন মিয়া আসিতে আসিতে চারিদিক আলাে হইয়া উঠিল। ততক্ষণে জেলেপাড়ার অনেকে ঘাটে আসিয়া দাঁড়াইয়াছে, উলুপী আসিয়াছে কলসি কাঁখে, স্বামীকে বিদায় দিয়া সে কলসি ভরিয়া বাড়ি ফিরিবে। লখা ও চণ্ডী আসিয়াই কুবেরের কাছে একটা করিয়া পয়সা দাবি করিয়াছিল, না পাইয়া তাহারা মুখ গোঁজ করিয়া আছে, বিদায় নেওয়ার সময় বাপের কাছে এতখানি নিষ্ঠুরতা তাহারা প্রত্যাশা করে নাই। রাসুও আসিয়া নৌকায় উঠিয়া বসিয়াছে। এমনিভাবে একদিন সকালবেলা সে ময়নাদ্বীপের উদ্দেশে রওনা হইয়াছিল। কিন্তু সেকথা রাসুর বুঝি আজ মনে নাই। নির্বিকার চিত্তে সে হােসেন মিয়ার নিকট বিড়ি চাহিয়া ধূমপান করে, যাচিয়া কুবেরকে বারবার শােনায় যে কুবেরের চিন্তার কারণ নাই, তাহার অনুপস্থিতির সময় সকলের দেখাশােনা সে-ই করিবে। কবে ফিরবা মাঝি? ঠিক নাই? তা হােক, রাসু যখন গ্রামে রহিল, বাড়ির জন্য কিসের ভাবনা কুবেরের?

 এবার নৌকা খুলিলেই হয়। কুবেরকে পথখরচের জন্য টাকা দিয়া হােসেন নামিয়া গেল। টাকার পরিমাণটা কুবেরকে অবাক করিয়া দিল—কী দরাজ হাত হােসেন মিয়ার! ভয়ও কুবেরের হইল বইকি! এতগুলি টাকা সামলাইয়া রাখা, হিসাব করিয়া খরচ করা, সে বড়াে সহজ কর্মভােগ নয়। সবচেয়ে অস্বস্তির কথা, টাকাটা হাতে আসিবামাত্র তাহার ভাবিতে ইচ্ছা হইতেছে তিন টাকায় যদি দু আনা বাঁচানাে যায় নিজের জন্য, চেষ্টা করিলে এতগুলি টাকা হইতে না জানি কত বাঁচানাে চলে! কাল হইতে এই কথাই সে থাকিয়া থাকিয়া ভাবিতেছিল বটে, ভাবিতেছিল কত টাকা হােসেন এবার তাহার হাতে দিবে—পথ খরচের টাকাটা অন্য কারাে জিম্মায় হােসেন এবার দিবে কিনা এ আশঙ্কাও তাহার ছিল না এমন নয়। আজ টাকাটা পাইয়া সে খানিক অভিভূত হইয়া রহিল। এতখানি বিশ্বাস হােসেন তাহাকে করে? হােসেন মিয়ার মতো মানুষকেও ফাঁকি দিতে পারিয়াছে ভাবিয়া একটু গর্বও কুবেরের হয়। না, লােকটা সর্বশক্তিমান নয়।

 কুবের তাে জানিত না যে তিন টাকায় দু আনার বেশি ফাঁকি দিবার সাহস তাহার নাই বলিয়াই হােসেন তাহাকে বিশ্বাস করে! পাঁচটা টাকা কুবের কোনােদিন চুরি করিতে