পাতা:পদ্মানদীর মাঝি - মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়.pdf/৭৬

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
৭৬
পদ্মানদীর মাঝি

ভাসমান কচুরিপানা, আকাশের পাখি ও মেঘ সব ভাসিয়া চলিয়াছে—তীরের দিকে চাহিয়া মনে হয় জলের সীমায় মাটির তীরভূমিও বুঝি লঘুগতিতে চলিয়াছে পিছনে।

 তবু নদী ছাড়া সবই বাহুল্য। আকাশের রঙিন মেঘ ও ভাসমান পাখি, ভাঙন-ধরা তীরে শুভ্র কাশ ও শ্যামল তরু, নদীর বুকে জীবনের সঞ্চালন, এসব কিছুই যদি না থাকে, শুধু এই বিশাল একাভিমুখী জলস্রোতকে পদ্মার মাঝি ভালােবাসিবে সারাজীবন। মানবী প্রিয়ার যৌবন চলিয়া যায়, পদ্মা তাে চিরযৌবনা। বৈচিত্র্য? কী তার প্রয়ােজন? নূতন পৃথিবী কে খোঁজে, কে চায় পদ্মার রূপের পরিবর্তন, শুধু ভাসিয়া চলার অতিরিক্ত মােহ?

 সকালবেলা সুবাতাস ছিল, তারপর বাতাস দিক পরিবর্তন করিল। বিশেষ কিছু অসুবিধা তাহাতে হইল না। দাঁড় টানিতে কোনাে কষ্ট নাই। নদীর স্রোতই নৌকা ঠেলিয়া নিয়া চলিয়াছে, ফিরিবার সময় উজান ঠেলিয়া আসিতে প্রাণ বাহির হইয়া যাইবে বটে, এখন আরামের অন্ত নাই।

 মধ্যাহ্নে নৌকা ভিড়াইয়া রান্নার আয়ােজন করা হইল। দুটি উনান খুঁড়িয়া দুইটি হাঁড়িতে চাপানাে হইল ভাত, কাছের এক গ্রামে তরিতরকারি মিলিল। নিজেদের জন্য রাঁধিবার ভারটা কুবেবের উপরেই পড়িয়াছিল, অদূরে রন্ধনরতা রসুলের বােন নছিবনকে দেখিতে দেখিতে কুবের মনে মনে একটু আপাশোশ করিল। ভাবিল, কি ক্ষতি মুসলমানের রান্না খাইলে? ডাঙার গ্রামে যাহারা মাটি ছানিয়া জীবিকা অর্জন করে তাহাদের মধ্যে ধর্মের পার্থক্য থাক, পদ্মানদীর মাঝিরা সকলে একধর্মী। গণেশ, শম্ভু ও বগা সঙ্গে না থাকিলে কুবের তাে নিজের জন্য রাঁধিতে বসিত না।

 খাওয়া-দাওয়ার পর আবার নৌকা চলিল। রাত্রি নটা দশটার সময় একেবারে নদীর কিনারায় সুষুপ্ত একখানি গ্রামের পাশে সেদিনকার মতাে স্থগিত করা হইল যাত্রা।

 তৃতীয় দিন অপরাহ্ণে পাওয়া গেল পদ্মা ও মেঘনার সঙ্গম। নদী এখানে সাগরের মতােই পারাপারহীন। সন্ধ্যার দেরি নাই দেখিয়া কুবের সেদিন নৌকা বাঁধিল, এদিকে সে আগেও আসিয়াছে বটে, কিন্তু নদী ভালাে করিয়া চেনা নয়, সন্ধ্যার পর নৌকা চালাইতে সে সাহস করিল না।

 পরদিন চাঁদপুরে নৌকা ভিড়িল।

 ভালােয় ভালোয় এতখানি পথ আসিয়া কুবেরের মনে আনন্দ ধরে না। এবার হােসেন মিয়া আসিয়া পড়িলেই সে সম্পূর্ণ নিশ্চিন্ত হইতে পারে। জাহাজঘাটে স্টিমার ভিড়িলে কুবের গিয়া যাত্রীদের অবরােহণ-পথটির মুখে দাঁড়াইয়া থাকে, মােটঘাট লইয়া দেশ-বিদেশের কত নরনারী তাহার সামনে দিয়া রেল স্টেশনের দিকে চলিয়া যায়, কুবেরের উৎসুক দৃষ্টি অনুসন্ধান করে হােসেনকে। সমস্ত যাত্রী নামিয়া আসিবার পরেও সে অনেকক্ষণ দাঁড়াইয়া থাকে।

 হােসেন আসিল তিন দিন পরে রাত্রের স্টিমারে।

 প্রতীক্ষা করিতে করিতে কুবের চঞ্চল হইয়া উঠিয়াছিল, হােসেনকে দেখিবামাত্র সমস্ত