পাতা:পদ্মানদীর মাঝি - মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়.pdf/৮৫

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
পদ্মানদীর মাঝি
৮৫

 পরদিন রাসু আসিল। কুবেরের দাবি শুনিয়া সে ভড়কাইয়া গেল। বলিল, অত টাকা কই পামু?

 কুবের তার কী জানে? এই কটা টাকা যদি সে বিবাহে খরচ করিতে না পারে, বিবাহের পর বউকে তবে সে খাওয়াইবে কোথা হইতে?

 রাসু মাথা নিচু করিয়া থাকে। মালা তাহার মুখের দিকে চাহিয়া বুঝি মমতা বােধ করে, কুবেরকে ইশারায় কাছে ডাকিয়া ফিশফিশ করিয়া টাকার পরিমাণটা কিছু কমাইতে বলিয়া দেয়। কিন্তু মেয়েমানুষের পরামর্শে ভুলিবার পাত্র কুবের নয়। গম্ভীর অবিচলিত মুখে সে বসিয়া থাকে বেড়ায় ঠেস দিয়া, চক্ষু মুদিয়া যেন ঘুমাইয়া পড়ে।

 অনেকক্ষণ পরে রাসু বলে, আইচ্ছা দিমু।

 বলিয়া সে উঠিয়া যাইতে চায় কিন্তু এবার কুবের তাহাকে খাতির করিয়া বসায়।. আগ্রহ সহকারে গল্প জুড়িয়া দেয় ময়নাদ্বীপের। রাসুর না জাগে উৎসাহ, না আসে মুখরতা। কী হইল রাসুর? এতদিনের স্বপ্ন তাহার সফল হইবে জানিয়া আহ্লাদ হইল না কেন? তামাক সাজিয়া খানিকক্ষণ টানিয়া হুঁকাটি নামাইয়া রাখিয়া কুবের আড়ালে যায়। কদিন আগেও তাহারা হুঁকা কাড়াকাড়ি করিয়া তামাক টানিয়াছে কিন্তু এখন কিনা রাসু তাহার ভাবী জামাতা, ওর হাতে এখন আর হুঁকা দেওয়া যায় না, ওর তামাক খাওয়ার সময় সামনে থাকা যায় না।

 দিন তিনেক পরে কুবের আমিনবাড়ি গিয়া গােপিকে দেখিয়া আসিল। হাসপাতালের খাবার খাইয়া বিছানায় শুইয়া শুইয়াই গােপি দিব্যি মােটাসােটা হইয়াছে, পরিষ্কার পরিছন্ন থাকার জন্য রঙের যেন তাহার খােলতাই হইয়াছে বেশ। দিন সাতেক পরে সে ছুটি পাইবে।

 রীতিমতাে শীত পড়িয়াছে এখন। জেলেপাড়ার ছেলেবুড়ার শরীর রুক্ষ হইয়া খড়ি উঠিতে আরম্ভ করিয়াছে। মালার চামড়া কিন্তু চিরদিন মসৃণ, হাজার শীতেও কখনও তাহার গা ফাটে না। কপিলারও বুঝি ফাটে না। যে তেলটাই কপিলা খরচ করে শরীরের পিছনে! মাঠে পালং শাকের পাতাগুলিতে যে সরস লাবণ্য ফুটিয়া আছে, কপিলার দেহে হয়তাে তার অভাব নাই। মালার বােন তাে সে। মালার চেয়ে সে হাজার গুণে শৌখিন।

 কাজকর্ম নাই, বাড়ি বাড়ি ঘুরিয়া কুবের সময় কাটায়। পীতম মাঝির অসুখ হইয়াছে, বুড়া বয়সে তাহার সেবা করিবার কেহ নাই, যুগী তুই আসিয়া বাপের কাছে আছে। পীতম সেবা গ্রহণ করে মেয়ের কিন্তু দিবারাত্রি তাকে গাল দিয়া কিছু রাখে না। যুগীর হাতের জল খাইয়া চিরদিন নরকে পচিবার সাধ যে তাহার নাই, সবসময় এই কথাটা সে ঘােষণা করে এবং ঘােষণা করিতে করিতে গলা কাঠ হইয়া আসিলে যুগীর দেওয়া জল খাইয়াই তৃষ্ণা মেটায়। পীতমের টাকা আছে অনেক। বলে, টাকার লােভে যুগী তাহার সেবা করিতে আসিয়াছে কিন্তু একটি পয়সা সে যুগীকে দিয়া যাইবে না। যা কিছু তাহার