পাতা:পদ্মানদীর মাঝি - মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়.pdf/৮৭

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
পদ্মানদীর মাঝি
৮৭

কাঁটা বিঁধে নাই। উঃ, বলিয়া কুবেরকে জড়াইয়া ধরিবার ছল সেটা কপিলার। কেতুপুরে দুর্গা-প্রতিমা দেখিয়া ফিরিবার সময় সেদিন কি ছলনাময়ীই কপিলা হইয়া উঠিয়াছিল!

 গােপিকে আনিবার নাম করিয়া কুবের একদিন ভাের ভাের গ্রাম ছাড়িয়া বাহির হইয়া পড়িল। শ্যামাদাসের বাড়ি আকুরটাকুর গ্রামে, হাঁটা পথে বারাে তেরাে মাইল। খেতের আল দিয়া আঁকিয়া বাঁকিয়া চলিতে চলিতে কতবার যে কুবের ভাবিল ফিরিয়া আসে, আকুরটাকুরে পৌঁছিয়া একটা পুকুরে মুখ হাত ধুইতে নামিয়া কতবার সে যে পুকুরঘাট হইতেই সােজা আবার আমিনবাড়ির দিকে হাঁটিতে আরম্ভ করা স্থির করিয়া ফেলিল তার হিসাব নাই!

 তবু শেষ পর্যন্ত শ্যামাদাসের বাড়ির দরজাতেই পথ শেষ হইল তাহার।

 শ্যামাদাস মাঠে গিয়াছিল। কিন্তু শ্যামাদাসের মা বােন ঘর-বাড়ি জুড়িয়া আছে, কপিলা এখানে ঘােমটা-টানা বউ। কুটুম্বকে শ্যামাদাসের মা খাতির করিয়া বসিতে দিল, কুশল ও এদিকে আসিবার প্রয়ােজন জিজ্ঞাসা করিল। শ্যামাদাসের বাড়িঘর দেখিয়া কুবের মনে মনে পীড়িত হইয়া উঠিয়াছিল। ভালােরকম জবাব দিতে পারিল না। চার ভিটায় চারখানা বড়াে বড়াে ঘর শ্যামাদাসের, চারিদিক লেপা-পােছা ঝকঝকে। ঘরের মধ্যে উঁকি দিলে কত জিনিস চোখে পড়ে—কাঠের সিন্দুক, বেতের ঝাঁপি, বাসনকোসন—কত কিছু। উঠানের একপাশে ধানের মরাই অপর পাশে গােয়ালঘর। লক্ষ্মীশ্রী মাখানাে সম্পন্ন গৃহস্থের ঘরসংসার, কুবেরের ভাঙা কুটিরের তুলনায় বৈকুণ্ঠপুরী। বুকের ভিতরে টাটায় কুবেরের। এই বৈকুণ্ঠের লক্ষ্মী গিয়া তাহার ভাঙা ঘরে শাকান্ন খাইয়া কটা দিন কাটাইয়া আসিয়াছিল বলিয়া আজও সে আকাশকুসুম রচনা করে, ভাবে আজও লক্ষ্মীর মন পড়িয়া রহিয়াছে কেতুপুরে তাহার সেই নােংরা নীড়টিতে! কী বােকাই কুবের ছিল!

 কপিলা জিজ্ঞাসা করে, খবর কী মাঝি? কী মনে কইরা আইলা? ভালা নি আছে পােলাপানরা?

 ডুরে শাড়ি পরিয়াছে কপিলা, চুলের তেলে কপাল তাহার ভিজিয়া গিয়াছে। দেহ যেন উথলিয়া উঠিয়াছে কপিলার, বর্ষার পদ্মার মতাে। কী ভীষণ খুশি মনে হইতেছে কপিলাকে! নিজের মলিন কাপড় ও চাদরটির লজ্জায় কুবেরের ছুটিয়া পলাইতে ইচ্ছা হইতে থাকে।

 কয়েক মিনিট সাধারণ কথাবার্তা বলিয়া কপিলা আবার রাঁধিতে যায়। আরও খানিকক্ষণ আলাপ করিয়া কপিলার শাশুড়িও প্রস্থান করে। বাড়ির একটি ছেলেমেয়ে শুধু ঘােরা-ফেরা করে কুবেরের কাছে, তারপর তারাও চলিয়া যায়। কুবের বসিয়া থাকে একা। বােকা, নােংরা, অপদার্থ কুবের। ময়নাদ্বীপের এনায়েত ও বসিরের কথা কুবেরের মনে পড়ে— মনে পড়ে জ্যোৎস্নালােকে হােসেনের কুটিরের দাওয়ায় বন্দি এনায়েতের ভাত খাওয়া; যার জন্য দ্বীপের অধিবাসীদের কাছে কবার সে মার খাইয়াছে, তারই আনিয়া দেওয়া ভাত! হােসেনের কল্যাণে কদিন পরে মিলনও তাদের হইবে—প্রকাশ্য, সামাজিক,