পাতা:পদ্মানদীর মাঝি - মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়.pdf/৯১

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
পদ্মানদীর মাঝি
৯১

রাসুর, দয়ামায়া আছে রাসুর বুকে, নকুল-টকুলের মতাে পাজি সে নয়। পীতম শােনে কিন্তু বিশ্বাস করে না, বলে, অরে তুই চিনস না কুবির, অ ডাকাইত। একদিন আমার বুকে চাকু মাইরা সর্বস্ব নিয়া পালাইব হারামজাদা, তুই আছস কোন্ তালে।

 কুবের প্রতিবাদ করে। না, রাসু সেরকম নয়। বড়ো ভালাে রাসু।

 কয়েকদিন পরে হােসেন মিয়া ফিরিয়া আসিলে কুবেরের অলস দিনগুলি শেষ হয়। রকমারি ব্যাবসা হােসেনের, ধান, পাট, বিড়ির পাতা, তামাক, গুড়, চিনি, মশলাপাতি, এক একবার এক একরকম বােঝাই নিয়া কুবের বন্দর হইতে বন্দরে যাতায়াত করে। গােয়ালন্দের অপর তীরে একবার সাতশাে ছাগল আসিয়া হাজির, সারাদিন ধরিয়া কুবের তাহাদের নদী পার করিল। ছাগলের গন্ধে বারবার তাহার মনে পড়িতে লাগিল কপিলার বাড়িতে এক কষ্টকর রাত্রিযাপনের কথা। পরের বাড়িতে পরের শাসনে নিরুপায় নির্বাক বউ কপিলা যেখানে তাকে পাট-জমানাে পাঁঠা-বাঁধা ভাঙা ঘরখানায় শুইতে দিয়াছিল।

 তারপর একদিন চাঁদপুর যাওয়ার হুকুম পাওয়া গেল। তাড়াতাড়ি যাইতে হইবে, দিবারাত্রি নৌকা বাহিয়া যাওয়া চাই। গণেশ বিরক্ত হইয়া গজগজ করিতে লাগিল। শম্ভু ও বগা বহুদিন হােসেনের অধীনে কাজ করিয়াছে, তারা কিছুই বলিল না, প্রাণপণে বইঠা বাহিয়া কুবেরকে অবাক করিয়া দিল। হােসেনকে কিছু কিছু কুবের এখন চিনিতে পারিয়াছে। সাধারণত সময়ের হিসাব হােসেনের একটু শিথিল, নৌকার খেপ দিতে মাঝিরা দেরি করিলে কিছু সে বলে না, শম্ভু ও বগা তাই গা ছাড়িয়া দিয়া বইঠা ধরে, কুবেরের তাড়া গ্রাহ্য করে না। কিন্তু হােসেন যখন মুখ ফুটিয়া বলে যে দ্রুতগতির প্রয়ােজন, শম্ভু ও বগার সমস্ত শৈথিল্য তখন অন্তর্হিত হয়। এমনভাবে বইঠা বাহিতে থাকে তাহারা যেন ভূতে পাইয়াছে তাহাদের। মনে মনে সায় দেয় কুবের। এমনিভাবেই কাজ নিতে হয় বটে মানুষের কাছে, এমনই কৌশলে। একটু দেরিতে যখন কিছুই আসিয়া যায় না, মাঝিদের সঙ্গে তখন বকাবকি না করিলে, তাড়াতাড়ির সময় দুবার বলিতে হয় না, এতটুকু ইঙ্গিত পাইলে আলস্য-পরিতৃপ্ত মাঝিরা সহসা অতিমাত্রায় কর্মঠ হইয়া ওঠে।

 হােসেনের বহুমুখী প্রতিভার পরিচয় কুবের প্রতিনিয়তই পায়। বিস্তৃত তাহার কর্মক্ষেত্র, এখানে ওখানে ছড়ানাে তাহার জীবন, এলােমেলাে তাহার চলাফেরা—তবু চারিদিকে সামঞ্জস্য, সব নিয়মে বাঁধা। একটা জটিল বিশৃঙ্খলায় সে সব শৃঙ্খলবদ্ধ করিয়া দিয়াছে।

 চাঁদপুরে হােসেন মিয়া নৌকায় যােগ দিল। ময়নাদ্বীপের পথেই এবারও নৌকা চলিল, নোয়াখালির উপকূলে ক্ষুদ্র একটি গ্রামের কাছে নৌকা বাঁধা হইল। নৌকায় বােঝাই দেওয়া হইল নারিকেল। বােঝাই শেষ হইল কিন্তু নৌকা খুলিবার হুকুম হােসেন দিল না। দুদিন সেইখানে নিষ্কর্মা হইয়া তাহারা বসিয়া রহিল।

 তৃতীয় দিন সন্ধ্যার সময় নদীর মােহনার দিক হইতে মুসুরি বােঝাই প্রকাণ্ড একটা সমুদ্রগামী বােট আসিয়া ভিড়িল পাশে, চট্টগ্রামবাসী এক বৃদ্ধ মুসলমান নামিয়া আসিয়া অনেকক্ষণ হােসেনের সঙ্গে করিল পরামর্শ। বােট হইতে তারপর ত্রিপলমােড়া কী যেন