পাতা:পুর্ব্ববঙ্গ গীতিকা (চতুর্থ খণ্ড) - দীনেশচন্দ্র সেন.pdf/৫২০

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
৫১৬
পূর্ব্ববঙ্গ গীতিকা

সঙ্গে তাহার তরুণ বন্ধুর কথাবার্ত্তার পরে অনেক ঘটনা কবি বাদ দিয়া গিয়াছেন। কুমারী বলিতেছেন, রাজপুত্র তাঁহাকে বিবাহ করিতে জেদ করিতেছেন,―তাঁহার পিতা কন্যাকে রাজমহিষী করিবার প্রলোভনে লুব্ধ হইয়াছেন―কিন্তু তিনি কখনই রাজকুমারকে বিবাহ করিবেন না, ইহা তাহার পণ। তিনি রাজপুত্রকে ঘৃণা করেন, এ কথা তাঁহার পিতাকে তিনি খুলিয়া বলিবেন। তাহার পরের অধ্যায় পড়িলে স্পষ্টই দেখা যাইবে যে রাজপুত্রের বিবাহের প্রস্তাবটি কন্যার একান্ত অনিচ্ছার দরুন বণিক ভাঙ্গিয়া দিলেন, তাঁহার তরুণ বন্ধুর সঙ্গে কুমারীর বিবাহ হইল;―দাম্পত্যের প্রথম অধ্যায়ে মিলন-মধুর কত দিনরাত্র চলিয়া গেল―এ সমস্ত কথাই কবি বাদ দিয়া গিয়াছেন। বণিক্‌-কুমারীর সঙ্গে বণিক্‌-কুমারের প্রথম দিনকার কথাবার্তার পর কবি পটক্ষেপ করিয়া যখন যবনিকা পুনরায় উত্তোলন করিলেন,―তখন একটা বিদায়দৃশ্য উদ্ঘাটিত হইল। তরুণবণিক্‌ সমুদ্রপথে যাত্রা করিতেছেন, সাশ্রুনেত্রে বণিক্-কন্যা―মেঘ উঠিলে ডিঙ্গা তীরে লাগাইতে, ঝড়ের সময় সাবধান হইতে এবং আরো কত কি পরামর্শ দিয়া তাঁহার উৎকণ্ঠা জ্ঞাপন করিতেছেন। প্রথম অধ্যায় এবং দ্বিতীয় অধ্যায়ের মধ্যবর্ত্তী ঘটনাগুলির ইঙ্গিত আছে কিন্তু বিবৃতি নাই, পাঠক কল্পনার দ্বারা তাহা পূরণ করিবেন।

 এই গানটিতে যে ভাষা পাওয়া যায় তাহাও আমাদের চণ্ডীদাসের যুগই স্মরণ করাইয়া দেয়। সুকোমল মনোভাব, স্নিগ্ধ ও করুণ রসে সিক্ত হইয়া বাঙ্গালার প্রণয়ী-প্রণয়িনীর শত শত আবদার ও আদরের মধুবর্ষী কথার সৃষ্টি করিয়াছিল। জয়দেবের পূর্ব্ব হইতে বাঙ্গালীর কবিতার এই লক্ষণ পরিদৃষ্ট হয়। কিন্তু তথাপি দেবভাষার অনুস্বার-বিসর্গের বাহুল্যে ওই সকল ভাব সংস্কৃতে ততটা কোমল হইতে পারে নাই―যতটা বাঙ্গালায় হইয়াছে। এই পেলব ভাষার পরিণতি বৈষ্ণব গীতিকায়―কিন্তু কতকগুলি পালাগানের ভিতরেও ভাষার এই কোমলতার এবং সূক্ষ্ম মনোভাববিশ্লেষণের বিশেষ পরিচয় পাওয়া যায়। আমরা এই সকল কারণে বগুলার বারমাসীটি খৃষ্টীয় পঞ্চদশ শতাব্দীতে বিরচিত হইয়াছিল বলিয়া মনে করি।

 বারমাসীটি একটু মামুলি রকমের, কিন্তু উহা যেরূপই হোক, বাঙ্গালী পাঠকের নিকট এই বারমাসীর আদর কখনই ফুরাইবে না; কারণ