পাতা:পুর্ব্ববঙ্গ গীতিকা (চতুর্থ খণ্ড) - দীনেশচন্দ্র সেন.pdf/৫৪৯

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
রাজা তিলকবসন্ত
৫৪৫

দিগকে কোন অংশে খাটো করিয়াছেন। ইহাতে সতীত্বের ব্যাখ্যা, স্বামিভক্তির উপদেশ এ সকলের কোন বালাই নাই। আছে শুধু সেই আদর্শটি, যাহা হিন্দু মহিলারা এখনও পর্য্যন্ত অনুসরণ করিয়া গৌরব বোধ করেন। সুতরাং যদিও খাস পল্পী-সাহিত্যের নায়িকার মত এই দুই মহিলা শুধু প্রেমের অনুপ্রাণনায় সমাজকে তুচ্ছ করিয়া ভিন্ন আদর্শের মহিমা প্রদৰ্শন করেন নাই, তথাপি অপরাপর পালার উৎকৃষ্ট নায়িকাদের পঙ্‌ক্তিতে আমরা ইঁহাদিগের আসন নির্দ্দেশ করিতে পারি।

 রাজার বনবাসের চিত্র বড়ই মনোজ্ঞ হইয়াছে। কাঠুরিয়াদিগের সরল ব্যবহার, ঐকান্তিক যত্ন এবং স্বাভাবিক শীলতা এত সুন্দর হইয়াছে যে আমাদের মনে হয়। সেই তরুলতার দেশের তরুলতার মতই ইহারা নৈসৰ্গিক শোভা প্রদৰ্শন করিতেছে। মানুষ বিপদে পড়িলে কতটা সহিষ্ণু হইতে পারে, পবনকুমারী তাহা দেখাইয়াছেন। পালাগানে সচরাচর আমরা নায়কদিগকে কতকটা হীনভাবাপন্ন দেখিতে পাই। নায়িকারাই অধিকাংশ স্থলে চরিত্র-গৌরবে আমাদিগকে মুগ্ধ করেন। কিন্তু নায়কগণের মধ্যে অনেকেই বিপদ্ বা প্রলোভনে পড়িলে তাঁহাদের আদর্শচ্যুত হইয়া আমাদের অবজ্ঞাভাজন হন। কিন্তু এই পালাটিতে যেমন তিলকবসন্ত, তেমনি তাঁহার দুই রাজ্ঞী। এই তিনটি চরিত্রই অতি মহৎ। অবশ্য তিলকবসন্ত দুইটি দার পরিগ্রহ করিয়াছিলেন। পাশ্চাত্ত্য আদর্শে তিনি হয়ত-বা এজন্য একটু গৌরবহীন হইয়া থাকিবেন, কিন্তু পালাটি পড়িলে এই দুইবার দার-পরিগ্রহের জন্য কোন স্থানে আমাদের বেদনা বোধ বা দাগ থাকে না। তিলকবসন্ত সর্ব্বত্রই উজ্জ্বল, সহিষ্ণু, প্রেমিক, একনিষ্ঠ এবং বীর। তাঁহার দানের অবধি নাই, ধৈর্য্যের সীমা নাই, আনন্দের ত্রুটি নাই। যখন তিনি চক্ষু দুইটি উপ্‌ড়াইয়া ভিক্ষুক ব্রাহ্মণের হস্তে দিলেন, তখন রাণী কাঁদিতে কাঁদিতে নিজের বস্ত্রাঞ্চলে তাঁহার চক্ষু মুছাইতে গিয়া সত্যই বলিয়াছিলেন-“তোমার মত লোক জগতে জন্মে নাই, তুমি নির্বিবকারভাবে এখনও ভগবান্‌কে আশ্রয় করিয়া আছ।” পালার শেষে যখন দুইটি সপত্নী জানু পাতিয়া বসিয়া রাজাকে প্রণাম করিয়া নূতন গৃহস্থালীর পত্তন করিলেন, তখন কবি সত্যই বলিয়াছেন—এ যেন সোণার হারে

৬৯