পাতা:পুর্ব্ববঙ্গ গীতিকা (দ্বিতীয় খণ্ড দ্বিতীয় সংখ্যা) - দীনেশচন্দ্র সেন.pdf/১০১

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
ভূমিকা
৯৩

যাইবা কোথা।” কঙ্ক লীলার “মুষ্টিতে ধরিতে পারি কটি খানি সরু” (৩।৭) কৃত্তিবাসের “মুষ্টিতে ধরিতে পারি সীতার কাঁকালি” র অনুরূপ। ভেলুয়ার—“মনে বিষ মুখে মধু এতেক কহিয়া। ভেলুয়ার নিকটে গেল বিদায় মাগিয়া॥” (২য় খণ্ড ৫০ পৃঃ) পদটি কবিকঙ্কণের “মনে বিষ মুখে মধু জিজ্ঞাসে ফুল্লরা। ক্ষুধাতৃষ্ণা দূরে গেল রন্ধনের ত্বরা।” পদটি স্মরণ করাইয়া দিবে।

 অনুসন্ধিৎসু চক্ষে পাঠ করিলে পাঠক এই পল্লীগীতিকাগুলিতে আমাদের ভাষালক্ষ্মীর অবগুণ্ঠন মোচন করিয়া তাঁহার স্বরূপটি দেখিতে পাইবেন। এই গীতিকা বঙ্গসাহিত্যের মণিময় আকর স্বরূপ। পল্লীতেই এদেশের প্রাণের কথা, মর্ম্মোচ্ছ্বাস, স্বভাব-সুলভ সরল কবিত্ব—বনজ পুষ্পের ন্যায় প্রথম ফুটিয়াছিল। মালীরা তাহাই লইয়া কৌশলে হার গাঁথিয়াছেন। উত্তর কালে যাত্রা, কথকতা, কবিগান, কীর্ত্তন ও মঙ্গলগান উৎসবনিশীথে যে আনন্দধারা বিলাইয়াছে—তাহার মূল—নির্ঝর—তাহার হরিদ্বার,—এই গীতিকা সমূহ।

 এই পালা গানের একধারা ধোপার পাট, কাঞ্চনমালা ও চন্দ্রার ন্যায় উপাখ্যানে স্বর্গীয় মন্দাকিনীর অনাবিল পবিত্রতা প্রকট করিতেছে; অপর একধারা ময়নামতীর গান, নিজাম ডাকাইতের পালা, প্রভৃতি আখ্যানে অপ্রাকৃত এবং দুর্ভেদ্য প্রহেলিকার সৃষ্টি করিয়া ভোগবতীর ন্যায় কোন নিগূঢ় তান্ত্রিক রাজ্যের দিকে ছুটিয়াছে; তৃতীয় ধারা—মাণিকতারার কাহিনীতে ফলপুষ্পশোভিত, হর্ষ-দ্বন্দ্ব-সুখ-ক্ষোভ-সম্মিলিত এই পার্থিব রাজ্যের মধ্য দিয়া গঙ্গাধারার ন্যায় সাধু-অসাধু, পুণ্য ও পাপ—এই দুই কূল প্রতিবিম্বিত করিয়া দেখাইতেছে— কখনও বা তাহা দুকূল ভাঙ্গিয়া প্রাচীন ঐতিহাসিক কীর্ত্তির কঙ্কাল প্রকাশ করিয়া দেখাইতেহে।

 এক সময়ে—হয়ত বা হিন্দুরাজার আমলে—যখন পূর্ব্ববঙ্গে শূরবংশের রাজধানী ছিল—তখনকার দিনে রাজপ্রাসাদ হইতে মাল্যচন্দন পাইয়া যশের তিলক মণ্ডিত ললাটে গায়েনেরা সমস্ত বঙ্গদেশে এই ভাবের গান ও রূপকথার ফিরি দিয়া হাটে পথে তাহাদের কোমলকান্ত পদাবলী ছড়াইয়ছিল, এই জন্য পূর্ব্ববঙ্গের সীমান্তে, উত্তরবঙ্গে ও পশ্চিম বঙ্গে কাব্য কথার মধ্যে এইরূপ আশ্চর্য্য ঐক্য পাওয়া হাইতেছে