পাতা:পুর্ব্ববঙ্গ গীতিকা (দ্বিতীয় খণ্ড দ্বিতীয় সংখ্যা) - দীনেশচন্দ্র সেন.pdf/১৪

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
১৬
পুর্ববঙ্গ গীতিকা

হইয়াছেন, কাঞ্চন সন্ন্যাসীর নিকট স্বামীর চক্ষুদান ভিক্ষা করিতেছেন। সন্ন্যাসী তাঁহাকে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ করাইলেন, তিনি যাহা চাহিবেন, তাহাই কাঞ্চনকে দিতে হইবে। “আমার রাজত্ব লইয়া উহার দৃষ্টি ফিরাইয়া দিন,” সন্ন্যাসী এই দানে মাথা নাড়িলেন। “আমার দুটি চক্ষু লইয়া উঁহার চক্ষু দিন,” এবারও সন্ন্যাসী মাথা নাড়িয়া অসম্মতি জানাইলেন। “তবে কি?” “তুমি এই ফলটি লও, ইহার সঙ্গে তোমার এই সাম্রাজ্য কুঞ্জকে দান কর। কিন্তু অপেক্ষা কর, এই দানই চূড়ান্ত নহে; ইহার সঙ্গে তুমি সমস্ত স্বত্বত্যাগ করিয়া তোমার স্বামীকেও ইহাকে দান কর। শুধু তাহাই নহে। দান করিবার সময় তোমার বুক যেন কাঁপিয়া না উঠে, একটি দীর্ঘ নিশ্বাস কিংবা অশ্রু যেন পতিত না হয়; তবেই তোমার স্বামী চক্ষু পাইবেন, নতুবা নয়।”

 কাঞ্চনের শঙ্কিত স্বামী-গত প্রাণ আর্ত্তনাদ করিয়া উঠিল। “আর এ জন্মে স্বামীকে দেখিতে পাইবনা, সপত্নীকে এই আমার যথাসর্ববস্ব দিয়া চলিয়া যাইতে হইবে। কাঁদিবার অধিকার পর্য্যন্ত আমার থাকিবে না,” মুহুর্তের উৎকণ্ঠার পর তিনি স্থির হইয়া নিজের সুখ অপেক্ষা স্বামীর ইষ্টকে বড় করিয়া দেখিলেন। পাষাণ হইয়া মুখের অপ্রসন্নতা ঘুচাইয়া, সপত্নীর হস্তে স্বামীকে সমর্পণ করিয়া চলিয়া গেলেন। এই মহীয়সী মূর্ত্তি কি মাইকেল এঞ্জেলো পাথরে গড়িতে পারিতেন?

 কবির বৈশিষ্ট্য ও প্রধান গুণ এই যে তিনি এই কাহিনীতে কোনও পক্ষপাতিত্ব দেখান নাই। কাঞ্চনের কষ্টেও তাঁহাকে যেমন করুণায় নিমজ্জিত করিয়াছে, কুঞ্জকেও তিনি তেমনই সহৃদয়তার সঙ্গে অঙ্কন করিয়াছেন। কেবল শেষ অঙ্কে কাঞ্চন যে শুধু প্রেমিকা নহেন, তিনি যে দধীচির মত নিজ অস্থি দিয়া স্বামীর জন্য সর্ব্বত্যাগিনী হইতে পারেন, তাহাই দেখাইয়া তাঁহাকে সমধিক শ্রেষ্ঠত্ব প্রদান করিয়াছেন। তিনি রমণী হৃদয়ে ঘা দিয়াছেন সেই জায়গায়, যে জায়গা সর্ব্বাপেক্ষা কোমল। যে সপত্নী তাঁহাকে ভয়ঙ্কর অপবাদ দিয়া নির্ব্বাসিত করিয়াছেন, সেই সপত্নীর অঙ্কে স্বামীকে দিয়া নিজে ভিখারিণীর বেশে দেশ ছাড়িয়া চলিয়া গেলেন। স্ত্রী লোকের হৃদয়ের “দুর্ব্বলতম স্থানটি কৃষক কবি যে আবিষ্কার করিতে পারিয়াছিলেন, শুধু এইজন্য তাঁহাকে অসামান্য প্রতিভাসম্পন্ন বলিতে হয়।