পাতা:পুর্ব্ববঙ্গ গীতিকা (দ্বিতীয় খণ্ড দ্বিতীয় সংখ্যা) - দীনেশচন্দ্র সেন.pdf/২৩

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
ভূমিকা
২৫

চন্দন প্রচুর পরিমাণে দিল্লীতে প্রেরণ করিতেন এবং তিনি “গারো তন্বী মন্‌সবী” এই উপাধিও সম্রাটের নিকট হইতে লাভ করেন।

 পালাগানোক্ত চরিত্রগুলিও যেমন ঐতিহাসিক ব্যক্তি, সেইরূপ মূল আখ্যায়িকার বিষয়ভাগও ঐতিহাসিক ঘটনামূলক। প্রিয়তমা রাণীর নামে উৎসর্গ করিবার সঙ্কল্পে রাজা জানকীনাথ কর্ত্তৃক কমলা-দীঘি খনিত হয়, কিন্তু তাহার ‘শুকোদ্ধার’ অর্থাৎ জলাগম হইল না। দীঘিতে জল না আসিলে দীঘিকারকের চতুর্দ্দশ পুরুষ পর্য্যন্ত নরকগামী হইতে হয়,—এই প্রাচীন সংস্কারের দরুণ রাজা এবং তাঁহার পাত্রমিত্র ও প্রজাবর্গ যখন চিন্তাক্লিষ্ট হইয়া উঠিলেন, তখন রাজা একদিন স্বপ্ন দেখিলেন যে রাণী পুষ্করিণী গর্ভে অবতরণ করিয়া জলসিঞ্চন এবং অপর কয়েকটি প্রক্রিয়া দ্বারা পুষ্করিণীতে জল আনয়ন করিতেছেন। এই স্বপ্নানুসারে রাণী সাধারণের হিতার্থে এবং স্বামীর পিতৃপুরুষদিগকে নিরয়গমন হইতে রক্ষা করিবার জন্য দীঘির জলে জীবন বিসর্জ্জন করেন। কমলারাণীর এই আত্মোৎসর্গ কল্পনামূলক নহে। প্রবাদটি দেশময় বহুকাল হইতে প্রচলিত, এবং সত্য ঘটনা মূলক। প্রাচীন সংস্কার অনুসারে গঙ্গাসাগরে শিশুবিসর্জ্জন প্রভৃতি ব্যাপারের ন্যায় দীঘিতে জল না হইলে নরবলি দেওয়া কিংবা আত্মোৎসর্গ করাও একটা রীতি ছিল। স্থানে স্থানে কবিত্বচ্ছটায় পালাগানটি উজ্জ্বল হইয়াছে। ১০ম খণ্ডে ১—১১ ছত্রে সূর্য্যোদয়ের যে বর্ণনাটি আছে, তাহা এত সুন্দর ও সরল কবিত্বময়, যে পড়িয়া মনে হয় যেন ঋগ্বেদের ঊষার স্তোত্র পাঠ করিতেছি। রমণী কমলার অসামান্য সংযম করুণরসকে নিবিড় করিয়া তুলিয়াছে। তিনি স্নেহশীলতা এবং অপূর্ব্ব ত্যাগ মণ্ডিত হইয়া দেবীর ন্যায় আমাদের ভক্তিপুষ্পাঞ্জলির পাত্রী হইয়াছেন।

 জানকীনাথকে নিষ্ঠুরতার অপবাদ দেওয়া যায় না। স্বপ্নের কথা শুনিয়াই রাণী আত্মবিসর্জ্জন করিবেন, ইহা তাঁহার অভিপ্রেত ছিল বলিয়া বোধ হয় না। বিশেষতঃ রাণীর বিচ্ছেদে তাঁহার উন্মত্ত শোকোচ্ছাস ও মর্ম্মস্পর্শী প্রলাপ বর্ণনা করিয়া কবি তাঁহার হৃদয়টির যে চিত্র দিয়াছেন, তাহা স্নেহ-প্রেমে ভরপুর। ধর্ম্মকার্য্যে বাধা দিতে তিনি সাহসী হন নাই—ইহাই তাঁহার দোষ। এ কথাটি ষোড়শ শতাব্দীর মাপকাঠি দিয়া বুঝিতে হইবে।