পাতা:পুর্ব্ববঙ্গ গীতিকা (দ্বিতীয় খণ্ড দ্বিতীয় সংখ্যা) - দীনেশচন্দ্র সেন.pdf/৩৭

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
ভূমিকা
৩৯

আবদ্ধ থাকে না; হিন্দু ও মুসলমান সেখানে অভিন্ন। জাতিবর্ণনির্ব্বিশেষে সমস্ত মনুষ্যজাতিই সাধুদিগের ধর্ম্মজীবনের অমৃতময় ফলভোগ করিতে পারেন। হিন্দুরা অনেক মুসলমানপীরের দরগায় পূজা দিয়া থাকেন; আবার মুসলমানেরাও অনেক হিন্দু সন্ন্যাসীকে শ্রদ্ধার চক্ষে দেখেন। পালাগানটির মুসলমান লেখক হিন্দুদিগের বহু তীর্থস্থানের প্রতি, এমন কি হিন্দুর উপাস্য রাধাকৃষ্ণ ও শক্তিদেবতা কালীর প্রতি শ্রদ্ধা জানাইয়াছেন। এখনও পল্লীগ্রামের মুসলমানেরা মনসার ভাসান এমন কি কালীকীর্ত্তন ও গান করিয়া উপজীবিকা অর্জ্জন করেন। উভয় শ্রেণীর এই উদারতাই হিন্দুমুসলমানমিলনের সুদৃঢ়ভিত্তিস্বরূপ হইয়া আসিয়াছে। দুঃখের বিষয় এখন কোন কোন স্থানে উভয় সম্প্রদায়ের গোঁড়ার দল কাল্পনিক মনোমালিন্যের সৃষ্টি করিয়া এই সুদৃঢ় প্রেমের বন্ধনকে নির্দ্দয়ভাবে ছিন্ন করিবার প্রয়াস পাইতেছেন।

 এই পালাগানে দুইটি নরহত্যাদ্বারা নিজাম ডাকাত ধর্ম্মজীবনের উচ্চস্তরে উঠিয়াছিলেন বলিয়া বর্ণিত আছে। সাধু উদ্দেশ্যে নরহত্যাও পুণ্যকার্য্য বলিয়া গৃহীত হইতে পারে, এই ধারণা হিন্দুদের গীতায়ও প্রমাণিত দৃষ্ট হয়। কিন্তু সুকোমল বাঙ্গালী হিন্দুর হৃদয়ে নরহত্যা কোন উদ্দেশ্যেই ধর্ম্মের সোপান বলিয়া গণ্য হইবে না। এই স্থানে বোধ হয় হিন্দু সাধুদের সম্বন্ধীয় পালাগানের সঙ্গে নিজাম ডাকাতের পালার একটু বৈষম্য দৃষ্ট হয়।

 পালারম্ভে বন্দনাগীতিতে বড় পীরসাহেবের নাম পাওয়া যাইতেছে। এখনও চট্টগ্রামের অন্তর্গত রঞ্জন থানার এলাকাধীন নোয়াপাড়া গ্রামে কর্ণফুলীতীরে এই বড় পীরসাহেবের দরগা বিদ্যমান রহিয়াছে। নোয়াখালি মৈমনসিংহ, ঢাকা, চট্টগ্রাম প্রভৃতি অঞ্চলের বহুদূরবর্ত্তী স্থান হইতে অনেক ধর্ম্মপ্রাণ মুসলমান এখনও এই বড় পীরসাহেরের দরগায় আসিয়া সিন্নি দিয়া থাকেন।

 পালাগানোক্ত সেখফরিদও একজন প্রসিদ্ধ পীর। চট্টগ্রাম সহরের মাত্র পাঁচ মাইল দূরে নসিরাবাদ নামক স্থানে এখনও সুলতান বাজেদ বষ্টামি নামক পীরের দরগা রহিয়াছে। এখানে একটি স্বচ্ছতোয়া প্রস্রবণকে লোকে ‘সেখফরিদের চসমা’ নাম দিয়াছে।