পাতা:পুর্ব্ববঙ্গ গীতিকা (দ্বিতীয় খণ্ড দ্বিতীয় সংখ্যা) - দীনেশচন্দ্র সেন.pdf/৮

এই পাতাটিকে বৈধকরণ করা হয়েছে। পাতাটিতে কোনো প্রকার ভুল পেলে তা ঠিক করুন বা জানান।
১০
পূর্ব্ববঙ্গ গীতিকা

বৈচিত্র্য সাধন করিতেছে। তাহার বাণিজ্যযাত্রার বিবরণের শেষভাগে বৃদ্ধ রজকের চিত্রটির অবতারণায় করুণ ‘রসের অভিনব উৎস প্রবাহিত হইয়াছে। পরিত্যক্তা কাঞ্চনমালা যে ভাবে নদীর জলে আত্মবিসর্জ্জন করিল, তাহাতে ত্যাগওপ্রেমের মহিমার অপূর্ব্ব শ্রী ফুটিয়া উঠিয়াছে। পাছে রাজকুমার তাহার মৃত্যু সংবাদে ব্যথিত ও অনুতপ্ত হন, এজন্য কাঞ্চন করজোড়ে প্রকৃতিকে তাঁহার মৃত্যু কথা গোপন করিতে অনুরোধ করিতেছেন। সম্মুখে তাহাঁদের অতীত সুখের স্মৃতি বহন করিয়া পত্র-শয্যার চিহ্ন এখনও বিদ্যমান। যেখান হইতে বঁধুর বংশী-সঙ্কেত শুনিয়া কাঞ্চন পাগলিনী হইয়া ছুটিতেন, নদীতীরে সেই স্মৃতিজড়িত স্থান এখনও রহিয়াছে। এই মিলনের মিলনান্ত অধ্যায় চিরতিমিরাবৃত। অতীত সুখস্মৃতি এবং বর্ত্তমান ব্যথার সন্ধিস্থলে রাজকুমারের পরম কল্যাণ কামনা করিতে করিতে অভিশপ্তা কাঞ্চনমালা নিজদেহ অনন্তে ভাসাইয়া দিয়া তাহার স্বর্গীয় প্রেমের উপসংহার করিলেন। এই গানে বাঁশের বাঁশীর যে সুরটি বাজিয়াছে, আদর্শ প্রেমের যে চিত্রটি ফুটিয়াছে, তাহা অপর এক যুগে বৈষ্ণবেরা ভাষাসম্পদে বিচিত্র করিয়া উপস্থিত করিয়াছেন। যদিও এই গানটির মধ্যে অনেক ছত্র চণ্ডীদাসের পদের সঙ্গে মিলিয়া যায়, তথাপি আমরা বলিতে বাধ্য যে এই সকল কৃষকের গান আদৌ বৈষ্ণবপ্রভাবে রচিত হয় নাই। ইহাতে ছায়া-নিবিড় বাঙ্গলার পল্লী-হৃদয়ের সহজ ভাব-প্রবণতার সেই বিশাল খনি আবিষ্কৃত হইয়াছে, যাহা হইতে বৈষ্ণবেরা তাঁহাদের রত্নরাজী আহরণ করিয়াছিলেন। বৈষ্ণর কবি ও কৃষক কবি, কেহ কাহারও নিকট ঋণী নহেন। ইঁহাদের উভয়েই বাঙ্গালাদেশের ভাবখনির সন্ধান পাইয়াছিলেন; সেই ভাবমূলক যে সব চলিত-কথা দেশময় প্রচলিত ছিল, এবং সহজিয়ারা যাহা সাধনার দ্বারা উপলব্ধি করিয়াছিলেন, সেই চলিত-কথার ঋণ বৈষ্ণব কবি এবং কৃষক কবি উভয়েই গ্রহণ করিয়াছিলেন। যদি বৈষ্ণব কবিদের অপূর্ব্ব পদের সন্ধান এই সকল কৃষক কবি জানিতেন, তবে তাহাদের ভাষা কিছুতেই এত অমার্জ্জিত এবং প্রাকৃত-প্রধান থাকিতে পারিত না। ভাব ও রচনাভঙ্গীতে অনুমান হয় এই কবিতাটি চতুর্দ্দশ শতাব্দীতে রচিত হইয়াছিল।