পাতা:পুর্ব্ববঙ্গ গীতিকা (দ্বিতীয় খণ্ড দ্বিতীয় সংখ্যা) - দীনেশচন্দ্র সেন.pdf/৯৪

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
৮৬
পূর্ব্ববঙ্গ গীতিকা

—কুসুমাকীর্ণ পথে প্রবেশ করিয়া যে দুর্গম পন্থার অভিশাপকে স্বেচ্ছায় বরণ করিয়া লইয়াছেন, তাহার নিদর্শন এই গীতিকাগুলির পত্রে পত্রে পাইবেন। এই পল্লীগাথায় সেই সাধনপথের পথিক-রমণীদের পদচিহ্ন পড়িয়া আছে, সেই পাদপীঠের উপর বিশ্বের শির লুটাইয়া পড়িলেও তাহা অযোগ্য হইবে না।

 এই পল্লীগানগুলিতে যে সুর বাজিয়া উঠিয়াছে, তাহার আধ্যাত্মিকতা বৈষ্ণব-গীতিতে আরও মহান্ হইয়াছে। দেশব্যাপী এই প্রেমসাধনার দরুণ বঙ্গভাষা যেরূপ কোমল ও সুশ্রাব্য হইয়াছে, তাহা বিশেষরূপে প্রণিধানযোগ্য। বঙ্গভাষার সুকুমার শব্দ-সম্পদ্ অতুলনীয়। যাঁহারা বৈষ্ণবপদাবলী ইংরেজীতে অনুবাদ করিবার চেষ্টা পাইবেন, তাঁহারা পদে পদে অসুবিধা ভোগ করিবেন। ধরুন বাঙ্গালা একটা শব্দ “মান”—ইহা সংস্কৃত নহে। ইহারা জোড়া ইংজৌতে মিলিবে না, “মান” ও “মানিনী” শব্দের ইংরেজী প্রতিশব্দ ভাবিয়া পাওয়া যায় না। বাঙ্গালা “সোহাগ” কথায় যে কত মধুরতা নিহিত আছে, তাহা ভাষান্তরে ব্যক্ত হইবার নহে। ইহা ছাড়া “লাবনী”, “রঙ্গিনা”. “ডগমগ” প্রভৃতি কথা বাঙ্গালা অভিধানের বৈশিষ্ট্য দেখাইবে। আর একটা খাটি বাঙ্গালা কথা “ভাবিনী” (যথা “ভাবিনী ভাবের দেহা”—চণ্ডীদাস); এই শব্দের অর্থ চিন্ময়ী। বাঙ্গালা “এলায়ে” কথাটায় সে বশ আছে তাহা ভাষান্তর করিয়া বুঝান শক্ত (যথা “পরশ লাগি এলায়েছে গা”— জ্ঞানদাস)। “শীতল চরণ” —এই গ্রীষ্মপ্রধান দেশের পরম মধুর স্নিগ্ধতা ব্যঞ্জনা করিতেছে; শীতের দেশের ভাষায় অর্থ উল্টা হইয়া যায়। “শীতল তছু অঙ্গ পরশ রস লালসে” (জ্ঞান দাস) এবং “কই কই প্রেমময়ি—পরশিয়া অঙ্গ শীতল হই” (কৃষ্ণ-কমল)—এই পদগুলির “শীতল” শব্দের মধুরতা ইংরেজীতে কিরূপে বুঝাইতে পারা যাইবে? “রাঙ্গা চরণ”, আল্‌তা অথবা পদ্মের বর্ণের কথা মনে করাইয়া দেয়; তাহা বিদেশীয় ভাষায় বুঝান যায় না। ইহা ছাড়া “জপ”, “তপ”, “আরতি” প্রভৃতি কথা দেবমণ্ডপে পূজারীর শ্রদ্ধার ভাব জ্ঞাপন করিতেছে। বিদেশী ভাষায় তাহার জোড়া মিলিবে না। খাটি বাঙ্গালা ‘নিছুনি’ কথার তুলনা নাই; এমন কি বাঙ্গালায় ষড়ঋতুর পরিচিত আনন্দদায়ক মূর্ত্তিস্মারক “বাদর”, “শাঙন্” প্রভৃতি কথার