পাতা:পুর্ব্ববঙ্গ গীতিকা (দ্বিতীয় খণ্ড দ্বিতীয় সংখ্যা) - দীনেশচন্দ্র সেন.pdf/৯৭

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
ভূমিকা
৮৯

এখানে তিনটি “রণে” দ্রষ্টব্য। “আমার মত তোমার শতেক রমণী, তোমার মত আমার তুমি গুণমণি, যেমন দিনমণির কত কমলিনী—কমলিনীগণের ঐ একই দিনমণি।” এখানে তিন রকমের “মণি” পাওয়া যাইতেছে। “আমি নহি প্রেমযোগ্য, করেছিলাম প্রেম যজ্ঞ”—আর একটি উদাহরণ। “দাসীর এই নিবেদন, মনের বেদন”—পদে “বেদন” দুই বার পাওয়া যাইতেছে, অর্থ সম্পূর্ণ ভিন্ন। বাঙ্গালা ভাষায় সর্ব্বত্র এইরূপ সূক্ষ্ম কথার বুনুনী। এই ভাষা যাঁহারা তন্ন তন্ন করিয়া বিচার করিবেন, তাঁহারা ইহার অসাধারণ শক্তি হৃদয়ঙ্গম করিতে পারিবেন। সারেঙ্গ্ বাজাইয়া যখন বৈষ্ণব-ভিখারী গায়:—“আহা মরি, সহচরী, হায় কি করি, কেন এ কিশোরীর সুশর্ব্বরী প্রভাত হৈল” তখন সারেঙ্গের “ঋ” “ঋ”, গানের “রি” “রি” র সঙ্গে এমন বেমালুম মিশিয়া যায়, যেন কণ্ঠ ও যন্ত্র সমস্বরে একমন্ত্রে বাজিয়া উঠে। ইহা ভাষার অপূর্ব্ব ঐশ্বর্য্যের দ্যোতনা করিতেছে।

 এই পল্লীগীতিকাগুলি পড়িলে দেখা যাইবে, বৈষ্ণব কবিতার প্রভাব ইহাতে এক ফোঁটাও নাই। গীতিকাগুলির ভাষা অমার্জ্জিত, বৈষ্ণব কবির ভাষা মার্জ্জিত। গীতিকাগুলির প্রেমকথার মধ্যে মধ্যে একটা উচ্চরাজ্যের আভাস ইঙ্গিত আছে সত্য, কিন্তু তাহার। আধ্যাত্মিকতার ধার একেবারেই ধারে না। এগুলি গ্রাম্য প্রেমিক-প্রেমিকার কথায় পূর্ণ,—রাধাকৃষ্ণের লীলার কথা স্মরণ করাইবার মত তাহাদের মধ্যে কিছুই নাই। কোন কোনও গীতি চণ্ডীদাসেরও পূর্ব্বে বিরচিত হইয়া থাকিবে, কিন্তু অধিকাংশই পরবর্ত্তী কালের। এই পালাগান রচকেরা বৈষ্ণব কবিদের কোনও সন্ধানই রাখিতেন না। তাঁহারা নায়ক নায়িকার প্রেমে মশ্‌গুল হইয়া পালা রচনা করিয়াছেন। বৈষ্ণব ধর্ম্মের ধার তাঁহারা ধারেন না। তথাপি বড়ই আশ্চর্য্যের বিষয় এই যে, চণ্ডীদাসের রচনার সঙ্গে অনেক সময় ছত্রে ছত্রে ইঁহাদের অতীব বিস্ময়কর মিল দৃষ্ট হয়। আমরা তাহার কয়েকটা দৃষ্টান্ত দিতেছি। “ধোপার পাটে” এই ছত্রটি পাওয়া যায়—“জিহ্বার সঙ্গেতে দাঁতের পীরিতি, আর ছলাতে কাটে” (১২।৩০)। চণ্ডীদাসের “জিহ্বার সঙ্গেতে দাঁতের পীরিতি সময় পাইলে কাটে।” “ধোপার পাটে” “তোমার চরণে আমার শতেক পরণাম” (২৪ অঃ)—পদটি চণ্ডীদাসের এই সুন্দর গানটি মনে করাইয়া দিবে— “তোমার