পাতা:প্রকৃতি বনাম মানুষঃ একটি পরিকল্পিত সংঘাত - মাধব গাডগিল.pdf/১১

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

হায়দ্রাবাদ, গোয়ালিওর, ইন্দোর এবং ভূপাল প্রভৃতি দেশীয় রাজ্যগুলিতে নিয়মিত পাখিদের সমীক্ষা করতে যেতেন রাজ পৃষ্ঠপোষকতায়। এইসব সমীক্ষার অনেকগুলিই করেছিলেন হাগ হুইসলার নামের একজন আই পি এস আধিকারিকের সঙ্গে। সেলিম আলী পাখির ট্যাক্সোনমি বা বিন্যাসবিধির মতো কাঠখোট্টা বিষয়ে আদৌ উৎসাহী ছিলেন না। তিনি ওয়াশিংটন ডিসি-র স্মিথসোনিয়ন ইন্সটিট্যুশনের প্রধান এস ডিলন রিপ্লের সহযোগিতায় কাজ শুরু করেন। এখন নানা অসমর্থিত কাগজপত্র থেকে প্রকাশিত হচ্ছে যে রিপ্লে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে দক্ষিণপূর্ব এশিয়ায় আমেরিকার গুপ্তচরবৃত্তির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন, যদিও সেলিম আলী এইসব সম্ভাবনার কথা আদৌ মানতেন না। রিপ্লে দাবি করেন যে তিনি যুদ্ধের পর আমেরিকান ইণ্টলিজেন্স এজেন্সির সঙ্গে সমস্ত সংস্রব ত্যাগ করেছেন। আমি ব্যক্তিগতভাবে পরিষ্কার প্রমাণ পেয়েছিলাম যে পানামায় অবস্থিত স্মিথসোনিয়ন ইন্সটিট্যুশনের গবেষণাগারটি বায়োলজিক্যাল যুদ্ধের গবেষণায় যুক্ত ছিল। সেটা ১৯৬৭ সাল, ভিয়েতনাম যুদ্ধ তখন তুঙ্গে। যুদ্ধকালীন জৈব ও রাসায়নিক বিকারক ব্যবহারের জন্য, ভিয়েতনামের জীববৈচিত্র্যপূর্ণ বিপুল পরিমাণ অরণ্য ধ্বংস করার জন্য আমেরিকা অবশ্যই দোষী। ওরা মাইলাইতে ২০ বছরের যুদ্ধে প্রচুর মানুষের হত্যা করা ছাড়াও নিরীহ মহিলা এবং শিশুদের গণহত্যা করেছিল। স্মিথসোনিয়ন-এর গবেষণা নিরক্ষীয় অঞ্চলে, তাই অবশ্যই ভিয়েতনাম যুদ্ধের সন্ত্রাসে এই সংস্থার অবদান রয়েছে। ১৯৮০-তে আমি খুবই উৎসাহ নিয়ে বেঙ্গালুরুতে ডিলন রিপ্লের একটি বক্তৃতা শুনতে গিয়েছিলাম এবং হতচকিত হয়েছিলাম। বক্তৃতায় তিনি সরাসরি ভারতীয়দের প্রতি ঘৃণা ব্যক্ত করেছিলেন। তাঁর ব্যক্তিত্বের এই দিকটি সেলিম আলীকে এতটুকু বিচলিত করেনি দেখে আশ্চর্য হয়েছিলাম।

 মহারাজাগণ

 সেলিম আলী ভারতবর্ষের বহু রাজ্যেই, সেইসব রাজ্যের মহারাজাদের পৃষ্ঠপোষণায় বহু পাখিদের ওপর ক্ষেত্রসমীক্ষা করেছেন। সকলের সঙ্গেই ওঁর বেশ বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক ছিল। এইসব রাজারাজড়াদের খ্যাতি ছিল শুধু নিজেদের সম্পত্তি ভোগ করায় এবং ব্রিটিশ মনিবদের খুশি করায়। সাধারণ মানুষকে তারা অত পাত্তা দিতেন না বরং অভব্য আচরণ করতেন। এরমধ্যে ত্রিবাঙ্কুরের আইল্যোম থিরুনল গৌরী লক্ষী বাঈ প্রজাদের জন্য খুব ভালো স্বাস্থ্যব্যবস্থার প্রচলন করেছিলেন। এছাড়া বরোদার মহারাজা সায়াজি রাও গায়কোয়াড এবং কোলাপুরের শাহু মহারাজের মতো অবশ্যই কয়েকজন ন্যায়পরায়ন মানুষ ছিলেন, যারা তাদের প্রজাদের জন্য বেশ কিছু কল্যাণমূলক কাজ করেছেন। যাই হোক, এমন নিয়ম ছিল যে, মহারাজেরা তাদের রাজ্যের সাধারণ লোকের থেকে এক্কেবারে বিচ্ছিন্ন হয়ে থাকতেন। সেলিম আলির প্রথম পাখির সমীক্ষা ছিল মহীশূর রাজ্যে। তৎকালীন মহীশূরের রাজা, জয়াচামারাজেন্দ্র ওয়াদিয়ার, তাঁর নির্দিষ্ট লক্ষ্যভেদী ক্ষমতা আর লোকালয়ে ক্ষ্যাপা হাতি অথবা মানুষখেকো বাঘের উৎপাতের সময়ে ও পরে গুলি করার জন্য প্রজাদের কাছে বিশেষ পরিচিত ছিলেন। তাঁর রাজপ্রাসাদের সংগ্রহে শিকার করা অনেক পশুর বিজয়স্মারক ছিল। সেলিম আলীও শিকার করতে ভালোবাসতেন, অতএব দু’জনের মধ্যে বেশ বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে।

 এর থেকেই ইঙ্গিত পাওয়া যায় যে আমার গুরু ভারতীয় অভিজাত এবং ইউরোপিয়ানদের বিশ্বে একজন মনোমুগ্ধকর ব্যক্তিত্ব হলেও সাধারণ ভারতীয়দের থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন ছিলেন। এক অর্থে তিনি নিজেও একজন মহারাজা ছিলেন। ভারতের জাতীয় কংগ্রেসের তৃতীয় প্রেসিডেণ্ট বদরুদ্দীন ত্যাবজি-র মর্যাদাপূর্ণ ও ধনবান পরিবারের সদস্য ছিলেন তিনি।

11