পাতা:প্রকৃতি বনাম মানুষঃ একটি পরিকল্পিত সংঘাত - মাধব গাডগিল.pdf/১৩

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

এছাড়াও নানাভাবে জলাভূমি ব্যবহৃত হত; যেমন— বহু শতক ধ’রেই স্থানীয় মানুষ কুশ ঘাস সংগ্রহ করতেন। জলাভূমিটি এইভাবেই জীববৈচিত্র্যে সমৃদ্ধ হয়ে থেকেছে। এই হল সেই জায়গা যেখানে ১৯৩৮ সালের ১২ নভেম্বর ভারতের ভাইসরয় লর্ড লিনলিথো একদিনে ৪২৭২টা পাখি মেরেছিলেন। ব্রিটিশ শাসিত ভারতে ব্রিটিশদের বন্যপ্রাণী গণহত্যার শীর্ষ স্পর্শ হয়েছিল সেদিন।

 একইরকম কুসংস্কারাচ্ছন্ন ইণ্টরন্যাশনল ক্রেন ফাউণ্ডেশন (ক্রেন বা সারস পাখির সংরক্ষণ নিয়ে কাজ করে যে আন্তর্জাতিক সংস্থা)-ও সেলিম আলীর সুপারিশগুলো সমর্থন করেছিল। যার ফলশ্রুতিতে ওই স্থানীয় এলাকা ১৯৮২ সালে ন্যাশনল পার্কের তকমা পায়। ন্যাশনল পার্কের কড়া নিয়মকানুন স্থানীয় মানুষের জীবনজীবিকার সম্পূর্ণ পরিসমাপ্তি ঘটায়। ফলে মোষচারণের ওপরও নিষেধাজ্ঞা জারি হয় কোনোরকম বিকল্প ছাড়াই। প্রতিবাদ হয়েছিল। এরপর গুলিতে ৭ জন নিহত হয়েছিলেন। কিন্তু নিষেধাজ্ঞা বহালই রইল। এই হস্তক্ষেপ সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিত ফল নিয়ে এলো। জলপ্রিয় ঘাস Paspalum distichum-কে মোষ নিয়ন্ত্রণে রাখত। জলাভূমিতে পশুচারণ বন্ধ হতেই সে ঘাসের বেলাগাম বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে বেড়ে চলল পেল্লায় কচুরিপানা। যার ফল সবচেয়ে খারাপ হয়েছিল জলের পাখিদের জন্য, যে প্রজাতিটিই নাকি ছিল ন্যাশনল পার্ক ব্যবস্থাপনার অন্যতম লক্ষ্য। উড়ে আসা সাইবেরিয়ন ক্রেন বা সারসের সংখ্যাও কমতে থাকে। এ বিষয়ে ন্যাশনল পার্কের পাশেই আঘাপুরের গ্রামবাসিরা দুর্দান্ত কৌতুহলোদ্দীপক বক্তব্য রেখেছিলেন। ওরা বিশ্বাস করেন, ক্রেনগুলো আগে ওদের প্রধান খাদ্য মাটির নীচের মূল আর কন্দের নাগাল পেত কারণ কুশ ঘাস ওপড়ানোর ফলে মাটি এমনিতেই আলগা হয়ে থাকত। ন্যাশনল পার্ক ঘোষণা হতেই কুশ সংগ্রহ বন্ধ হয়ে যাবার ফলে মাটি জমাট বেঁধে থাকত আর সারসরা তাদের প্রিয় খাবারের নাগাল পেত না। এই সম্ভাবনাময় অনুমানটি সম্পর্কে পরবর্তী অনুসন্ধানের প্রয়োজন ছিল। যাই হোক, বিষয়টা অপরীক্ষিতই রয়ে গেল, কারণ ন্যাশনল পার্ক কর্তৃপক্ষের বিজ্ঞানে কোনো উৎসাহ ছিল না। BNHS এইসব ক্ষতিকারক ফলাফল নিয়ে চর্চা করে এবং US FISH AND WILDLIFE SERVICE-কে একটা রিপোর্ট জমা দেয়। কিন্তু এত গুরুত্বপূর্ণ তথ্য কখনোই কোনো বিজ্ঞানভিত্তিক জার্নালে প্রকাশ করেনি, পাছে দায় নিতে হয়।

 বন্যপ্রাণ আইন

 সেলিম আলী, তাঁর চা-কফি এস্টেট মালিক বন্ধুরা এবং মহারাজারা বন্যপ্রাণ আইন (Wildlife Protection Act)-এর প্রবক্তা। আইনটার মধ্যে দিয়ে সারা ভারতবর্ষ বন দপ্তরের অত্যাচারী থাবার ভেতর প্রবেশ করেছিল।১০ যে শিকারকে এই আইন অপরাধ ব’লে ঘোষণা করে তা আসলে মানবতার ঐতিহ্যের অংশ। ৩ লক্ষ বছর আগে পূর্ব আফ্রিকার সাভানার মানুষ আবির্ভূত হয়েছিল শিকারি গোষ্ঠী হিসেবে। আজ পর্যন্ত শিকার করা মাংসই পুষ্টির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উৎস হয়ে থেকেছে এযাবতকালের বিবর্তনের ইতিহাসে। পার্থক্য এটুকুই যে আফ্রিকায় মানুষ বুশমিট (ঝোপঝাড় থেকে শিকার করা বন্যপ্রাণীর মাংস) খায় আর স্যুইডিশরা, নরওয়েবাসীরা খায় মুজ নামের হরিণ। একমাত্র আধুনিক ভারতবর্ষ বাদে সর্বত্র শিকার সিদ্ধ। মাংসের জন্য না হলে, বিনোদনের জন্য; এখনো। সামাজিক স্তরবিন্যাসের মধ্যে ব্যক্তিগত উত্থানের প্রচেষ্টা সমস্ত গোষ্ঠীবদ্ধ স্তন্যপায়ীর মধ্যেই দেখা যায়, আমাদের প্রজাতির মধ্যেও। শিকারের সময় সাহস দেখানো এবং শিকারের নানা কৃতকৌশল গোষ্ঠী বা সমষ্টির অন্যান্য সদস্যদের কাছে মূল্য পায় এবং সামাজিক স্তরবিন্যাসে ব্যক্তির উত্থানের পথ সুগম করে। আনন্দদায়ক শিকার একজন মানুষকে শিকারের উন্নততর কৃতকৌশল শেখায় এবং

13