পাতা:প্রবাসী (অষ্টবিংশ ভাগ, প্রথম খণ্ড).djvu/৩২৯

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

সিটি-কলেজ সম্বন্ধে রবীন্দ্রনাথের চিঠি মডান রিভিয়ুতে সিটিকলেজ-ঘটিত ব্যপার সম্বন্ধে আমার যেমন্তব্য বেরিয়েছে তার উত্তরে একটা অদ্ভূত তর্ক শুনতে পাচ্ছি। কেউ কেউ বলচেন, ছাত্রের বেতন দিয়ে হোষ্টেলে বাস করে, তাদের সঙ্গে এমন কারো অধিকারের তুলনা হয় না র্যারা বিনাব্যয়ে কারো বাড়ীতে থাকেন। এ সম্বন্ধে আমার বল্বার কথা এই যে— ( ১ ) সিটি কলেজের কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে যারা বিদ্রোহ করেচেন তাদের প্রধান বর্গেরই মধ্যে কেউ কেউ হস্টেলবাসের অথবা অধ্যয়নের জন্তে কিছুই দেননি। এমন কি, কলেজ কর্তৃপক্ষ অনেকে তাদের আমুকুলাই করেচেন । এ কথা স্বীকার করতেই হবে যে, এরকম আমুকূল্যের দ্বারা ছাত্রদেরকে অসম্মানিত করা হয়, এটা কর্তৃপক্ষদেরই অপরাধ। এইরূপ অসন্মানিত চিত্তের বিরুদ্ধতা অপরিমিত উত্তেজনার আকারেই প্রকাশ পেয়ে থাকে। কলেজের বদান্ত কর্তৃপক্ষের এইটেই উপযুক্ত প্রায়শ্চিত্ত। এটা তাদের কৰ্ম্মফল । (২) বেতন দিয়ে হস্টেলে বাসের অধিকার স্বভীবতই সঙ্কীর্ণ। বেতন দিয়ে ক্লাসে পড়ার মতোই তার ব্যবহার সীমাবদ্ধ। কোনে ছেলে ক্লাসে গিয়ে নৃত্যগীত করলে অধ্যাপক তাকে বিদায় ক’রে দিতে পারেন সে ছেলে বেতন দেওয়া সত্ত্বে s । ভাড়া দিয়ে যারা কোনো বাড়ীতে থাকে তারা মদ খেয়ে মাৎলামি করলেও বাড়ীওয়ালা তাকে জবাব দিতে পারে না ; কারণ ভাড়াটে বাড়ী কোনো সামাজিক প্রতিষ্ঠান নয়। কিন্তু বেতন দিয়েচে ব’লেই হস্টেলের নিয়ম লঙ্ঘন করার অধিকার কারে নেই। হস্টেলবাস অনেকট রেলগাড়ীর যাত্রী হওয়ার মত ভাড়া দিলেও এবং সকল যাত্রী একমত হ’লেও গাড়ী নিজের . নিয়ম অনুসারেই চলে, যাত্রীদের খেয়ালমত চলে না। (৩) গৃহস্থের বাড়ীতে অনেক লোক বাস করেন, যারা সেখানে বাস করবার অধিকার পান কৰ্ম্মদানের পরি বর্তে বস্তুত তার অমনি থাকৃতে পান না, কাজের বদলে তাদের থাকৃবার দাবী আছে। যদি বাড়ীতে থাকৃতে না পেতেন তবে বেতনে সেই অভাব পুরিয়ে দিতে হত। অতএব প্রকৃতপক্ষে তারা বেতনের এক অংশ দিয়েই গৃহস্থের বাড়ীতে থাকৃতে পান। কিন্তু তাই বলে তারা সেই গৃহস্থের দালানে নিজের সাম্প্রদায়িক পূজা করতে না পেলে হিন্দুধৰ্ম্মই বিপন্ন হয়, এমন অদ্ভুত কথা কেউ বলতে পারে না। হিন্দু ধর্শ্বের যদি এই প্রকৃতিই সত্য হয় তবে এ দেশে যারা অহিন্দু বাস করে, তাদের পক্ষে বিশেষ উদ্বেগের কারণ আছে বলতে হবে। এমন কথাও কেউ কেউ বলেচেন, এই ব্যাপারে ধৰ্ম্ম । বিরোধটা গৌণ। তারা বলেন, সিটি কলেজের কর্তৃপক্ষের কতকগুলি গলদ ক’রে বসেচেন ব’লেই এই কাণ্ডটা ঘটেচে। প্রথমত, আমি জানিনে তাদের ব্যবহারে ক্রটি কি ঘটেছিল। দ্বিতীয়ত, যদি কিছু ঘটে থাকে সেটা স্বতন্ত্র নালিশের অন্তর্গত। তার বোঝাপড়ার মধ্যে হস্তক্ষেপ করতে পারি এমন ইচ্ছ। এবং অবকাশ আমার নেই। যারা সিটি কলেজের কর্তৃপক্ষের ব্যবহারে ক্রটি দেপ চেন, র্তার ছাত্রদের কোনো ব্যবহারে কোনো ত্রটি দেখ চেন ন। ছাত্রের হেরম্ববাবুর মতো মান্তলোকের গায়ে পানের পিক, গোবরের জল সিঞ্চন ক’রে উল্লাস প্রকাশ করেচে ; যে-ছেলের সিটি কলেজে পড়তে যেতে ইচ্ছুক তাদেরকে অবমাননা ও দৈহিক দগুবিধানের ভয় দেখিয়ে পরের ন্যায্য অধিকারে অবৈধ হস্তক্ষেপ পূৰ্ব্বক নিরস্ত করবার চেষ্টা করচে, অথচ এইসমস্ত রূঢ় আচরণ ও উপদ্রব সম্বন্ধে ছাত্রহিতৈষীরা কোনো কথা বলেন না। আমিও বলতে চাইনে। আমার আলোচনার প্রধান বিষয়টিই হচ্ছে পূজার অধিকারের সীমা নিয়ে। আমাদের দুর্ভাগ্য দেশে এর চেয়ে গুরুতর বিষয় আর কিছুই নেই। অথচ যারা ভারতে রাষ্ট্রক ঐক্য ও মুক্তিসাধনকে তাদের সমস্ত চেষ্টার একমাত্র লক্ষ্যরূপে গ্রহণ করেচেন তারাও যখন প্রকাশ্বে এই ধৰ্ম্মবিরোধকে পক্ষপাত দ্বারা উৎসাহই দিচ্ছেন, তারাও যখন ছাত্রদের এই স্বরাজনীতিগর্হিত আচরণে লেশমাত্র আপত্তি প্রকাশ করতে কুষ্টিত তখন স্পষ্টই দেখচি, আমাদের দেশের পলিটিক্স্ সাধনার পদ্ধতি নিজের ভীরুতায়, ছৰ্ব্বলতায় নিজেকে ব্যর্থ করায় পথেই দাড়িয়েছে। পরের সমালোচনা করার চেয়ে নিজের লোকদেরকে কঠোর অনুশাসনে স্তায়ের পথে নিয়ন্ত্রিত করার কাজটাই স্বরাজ্যসাধনের গুরুতর কর্তব্য,-এর অপ্রিয়তা স্বীকার করা জেলখানায় যাওয়ার চেয়ে অনেক বড়ো। যে-কোনো কারণেই হোক, তাতে যখন শৈথিল্য দেখি তখন কপালে করাঘাত ক'রে বলতেই হয়, বাইরের শত্রুর চেয়ে বড়ো শক্রকে অস্তরে দেখলুম-রাষ্ট্রসাধনায় জয়লাভ করার পক্ষে এইটে সবচেয়ে লক্ষণ। ২৩ বৈশাখ, ১৩৩৫ ঐ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর