পাতা:প্রবাসী (অষ্টম ভাগ).pdf/১০০

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

>nc ছিল না। পুৰ্ব্বেও এ পাড়ায় মাঝে মাঝে আগুন লাগিয়াছে, তাহাকে দৈবের উৎপাত বলিয়াই সকলে নিরুদ্যম হইয়৷ আছে, নিকটে কোনো প্রকার জলের ব্যবস্থা করিয়া রাখিবার জন্ত তাহদের কোনোরূপ চেষ্টাই জন্মে নাই। পাড়ার নিতান্ত প্রয়োজন সম্বন্ধেও যাহাঁদের বোধশক্তি এমন আশ্চৰ্য্য অসাড় তাহাধের কাছে সমস্ত দেশের অভাবের আলোচনা করা গোরার কাছে বিদ্রুপ বলিয়া বোধ হইল । সকলের চেয়ে গোরার কাছে আশ্চৰ্য্য এই লাগিল যে, মতিলাল ও রমাপতি এই সমস্ত দৃশ্বে ও ঘটনায় কিছুমাত্র বিচলিত হইত না—বরঞ্চ গোরার ক্ষোভকে তাহার। অসঙ্গত বলিয়াই মনে করিত। ছোটলোকরাত এইরকম করিয়াই থাকে, তাহারা এমনি করিয়াই ভাবে, এই সকল কষ্টকে তাহারা কষ্টই মনে করে না ; ছোটলোকদের পক্ষে এরূপ ছাড়া আর যে কিছু হইতেই পারে তাহাই কল্পনা করা তাহারা বাড়াবাড়ি বলিয়া বোধ করে। এই অজ্ঞতা, জড়তা ও দুঃখের বোঝা যে কি ভয়ঙ্কর প্রকাও–এবং এই ভার যে আমাদের শিক্ষিত অশিক্ষিত ধনী দরিদ্র সকলেরই কাধের উপর চাপিয়া রহিয়াছে, প্রত্যেককেই অগ্রসর হইতে দিতেছে না এই কথা আজ স্পষ্ট করিয়া বুঝিয়া গোরার চিত্ত রাত্রিদিন ক্লিষ্ট হইতে লাগিল । মতিলাল বাড়ি হইতে পীড়ার সংবাদ পাইয়াছে বলিয়৷ বিদায় লইল ; গোরার সঙ্গে কেবল রমাপতি অবশিষ্ট রহিল । উভয়ে চলিতে চলিতে একজায়গায় নদীর চরে এক মুসলমান পাড়ায় আসিয়া উপস্থিত হইল। আতিথ্যগ্রহণের প্রত্যাশায় খুজিতে খুজিতে সমস্ত গ্রামের মধ্যে কেবল একটি ঘর মাত্র হিন্দু নাপিতের সন্ধান পাওয়া গেল। দুই ব্রাহ্মণ তাহারই ঘরে আশ্রয় লইতে গিয়া দেখিল বৃদ্ধ নাপিত ও তাহার স্ত্রী একটি মুসলমানের ছেলেকে পালন করিতেছে। •রমাপতি অত্যন্ত নিষ্ঠাবান, সেত ব্যাকুল হইয়া উঠিল। গোরা নাপিতকে তাহার অনাচারের জন্য ভৎসনা করিতে সে কহিল, “ঠাকুর, আমরা বলি হরি, ওরা বলে আল্লা, কোনো তফাৎ নেই।” তখন “রৌদ্র প্রখর হইয়াছে—বিস্তীর্ণ বালুচর, নদী প্রবাসী । কুপ খনন করিয়া রাখে সঙ্গতিপন্ন লোকেরও সে চিন্তাই বহুদূর । রমাপতি পিপাসায় ক্লিষ্ট হইয়। কহিল,-" o,...! পানীয় জল পাই কোথায় ?" নাপিতের ঘরে একটা কাচ কুপ আছে-মি ভ্রষ্টাচারের সে কূপ হইতে রমাপতি জল ধাইতে না পারি মুখ বিমৰ্ষ করিয়া বসিয়া রহিল। গোরা জিজ্ঞাসা করিল, “এ ছেলের কি মা বাপ নেই? নাপিত কহিল, “দুই আছে, কিন্তু না থাকারই মত।" গোরা কহিল, “সে কি রকম ?” নাপিত যে ইতিহাসটা বলিল, তাহার মৰ্ম্ম এইঃযে জমিদারীতে ইহারা বাস করিতেছে তাহা নীলকা সাহেবদের ইজারা। চরে নীলের জনী লইয়া প্রজ্ঞানে সহিত নীলকুঠির বিরোধের অন্ত নাই। অন্ত সমস্ত গ্রন্থ বশ মানিয়াছে কেবল এই চর ঘোষপুরের প্রজাগিয়ে সাহেবরা শাসন করিয়া বাধা করিতে পারে নাই। এখানকার প্রজারা সমস্তই মুসলমান, এবং ইহাদের প্রধান ফরুসর্দার কাহাকেও ভয় করে না। নীলকুঠির উৎপা উপলক্ষ্যে দুই বার পুলিসকে ঠেঙাইয় সে জেল খাটা আসিয়াছে ; তাহার এমন অবস্থা হইয়াছে যে, তাহার । ভাত নাই বলিলেই হয় কিন্তু সে কিছুতেই দমিতে জানেন। এবারে নদীর কাচি চরে চাষ দিয়া এ গ্রামের লোকের ক্ষা বোরোধান পাইয়াছিল,—আজ মাসখানেক হইল নীলকুঞ্জি ম্যানেজার সাহেব স্বয়ং আসিয়া লাঠিয়ালসহ প্রজার ধান লুট করে। সেই উৎপাতের সময় ফরুসর্দার সাহেবের ডানহাতে এমন এক লাঠি বসাইয়াছিল যে ডাক্তারখানা লইয়া গিয় তাহার সেই হাত কাটিয়া ফেলিতে হইয়াছিল। এত বড় দুঃসাহসিক ব্যাপার এ অঞ্চলে আর কখনো ৷ নাই। ইহার পর হইতে পুলিষের উৎপাত পাড়ায় পাড়া যেন আগুনের মত লাগিয়াছে ;–প্রজাদের কাহারো ঘৰে কিছুই রাপিল না, ঘরের মেয়েদের ইজ্জত আর থাকে না; ফরুসর্দার এবং বিস্তর লোককে হাজতে রাখিয়াছে, গ্রায়ে বহুতর লোক পলাতক হইয়াছে। ফরুর পরিবার আজ নিরন ; এমন কি, তাহার পরনের একখানি মাত্র কাপড়ে । এমন দশা হইয়াছিল যে, ঘর হইতে সে বাহির হইছে । পারিত না; তাহার একমাত্র বালকপুত্র তমিজ, নাপিতো স্ত্রীকে গ্রামসম্পর্কে মাসী বলিয়৷ ডাকিত ; সে খাই | শাসন করিতেছে। ৪র্থ সংখ্যা । ] --WikitanvirBot (আলাপ) ১৪:১৮, ২৪ মার্চ ২০১৬ (ইউটিসি) - গানদেখিয়া নাপিতের স্ত্রী তাহাকে নিজের বাড়িতে আনিয়া পালন করিতেছে। নীলকুঠির একটা কাছারি ক্রোশদেড়েক ছাতে আছে, দারোগা এখনো তাহার দলবল লইয়া সেখানে আছে ; তদন্ত উপলক্ষ্যে গ্রামে যে কথন আসে এবং কি করে তাহার ঠিকানা নাই। গত কলা নাপিতের প্রতিবেশী বৃদ্ধ নাজিমের ঘরে পুলিসের আবির্ভাব ক্টোছিল। নাজিমের এক যুবক খালক, ভিন্ন এলেকা ইষ্টতে তাহার ভগিনীর সঙ্গে দেখা করিতে আসিয়াছিলiারোগ নিতান্তই বিনা কারণে “বেটী ত জোয়ান কম নয়, থেচ বেটার বুকের ছাতি”—বলিয়া হাতের লাঠিটা দিয়া তাহাকে এমন একটা খোচা মারিল যে তাহার দাত ভাঙিয়া রক্ত পড়িতে লাগিল, তাহার ভগিনী এই অত্যাচার দেখিয়া দুটা আসিতেই সেই বৃদ্ধাকে এক ধাক্কা মারিয়া ফেলিয়া লি। পূৰ্ব্বে পুলিস এ পাড়ায় এমনতর উপদ্রব করিতে সহসা সাহস করিত না কিন্তু এখন পাড়ার বলিষ্ঠ যুবাপুরুষ মাত্রই হয় গ্রেফতার নয় পলাতক হইয়াছে। সেই পলাতকগিকে সন্ধানের উপলক্ষ্য করিয়াই পুলিস গ্রামকে এখনো কবে এ গ্রহ কাটিয়া যাইবে তাহা কিছুই বলা যায় না। গোরা ত উঠিতে চায় না, ওদিকে রমাপতির প্রাণ বাহির হইতেছে। সে নাপিতের মুখের ইতিবৃত্ত শেষ ন হইতেই জিজ্ঞাসা করিল, হিন্দুর পাড়া কত দূরে আছে ? নাপিত কহিল—“ক্রোশ দেড়েক দূরে যে নীলকুঠির কাছারি আছে, তাহার তহশিলদার ব্রাহ্মণ, নাম মাধব চাটুয্যে।” গোরা জিজ্ঞাসা করিল—“স্বভাবটা ?” নাপিত কহিল “যমদূত বল্লেই হয়। এত বড় নির্দয় অথচ কৌশলী লোক আর দেখা যায় না। এই যে ক'দিন দারোগাকে ঘরে পুচে, তার সমস্ত খরচা আমাদেরই কাছ থেকে আদায় করবে—তাতে কিছু মুনফাও থাকবে।” রমাপতি কহিল—“গের বাবু চলুন, আর ত পারা যায় না।" বিশেষত নাপিতবে যখন মুসলমান ছেলেটিকে তাহাদের প্রাঙ্গণের কুয়াটার কাছে দাড় করাইয়া ঘটতে করিয়া জল তুলিয়া স্নান করাইয়া দিতে লাগিল তখন তাহার গোরা। - >Գ> মনে অত্যন্ত রাগ হইতে লাগিল এবং এ বাড়ীতে বসিয়া থাকিতে তাহার প্রবৃত্তিই হইল না। গোরা যাইবার সময় নাপিতকে জিজ্ঞাসা করিল, “এই উৎপাতের মধ্যে তুমি যে এ পাড়ায় এখনো টিকে আছ ? আর কোথাও তোমার আত্মীয় কেউ নেই ?” নাপিত কহিল—“অনেক দিন আছি এদের উপর আমার মায় পড়ে গেছে। আমি হিন্দু নাপিত, আমার জোতজমা বিশেষ কিছু নেই বলে কুঠির লোক আমার গায়ে হাত দেয় না। আজ এ পাড়ায় পুরুষ বলতে আর বড় কেউ নেই, আমি যদি যাই তাহলে মেয়েগুলো ভয়েই মারা যাবে।” গোরা কহিল, “আচ্ছা, পাওয়াদাওয়া করে আবার আমি আসব ?” দারুণ ক্ষুধাতৃষ্ণার সময় এই নীলকুঠির উৎপাতের সুদীর্ঘ বিবরণে রমাপতি গ্রামের লোকের উপরেই চটিয়া গেল। বেটার প্রবলের বিরুদ্ধে মাথা তুলিতে চায় ইহা গোয়ার মুসলমানের স্পর্ক ও নিৰ্বদ্ধিতার চরম বলিয়া । তাহার কাছে মনে হইল। যথোচিত শাসনের দ্বারা । ইহাদের এই উদ্ধত্য চূর্ণ হইলেই যে ভাল হয় ইহাতে তাহার সন্দেহ ছিল না। এই প্রকারের লক্ষ্মীছাড়াবেটাদের প্রতি পুলিসের উৎপাত ঘটয়াই থাকে এবংঘটতেই বাধ্য এবং ইহারাই সে জন্য প্রধানত দোৰী । এইরূপ তাহার ধারণা। মনিবের সঙ্গে মিটমাট করিয়া । লইলেইত হয়, ফেসাদ বাধাইতে যায় কেন, তেজ এখন । রহিল কোথায় ? বস্তুত রমাপতির অন্তরের সহানুভূতি । নীলকুঠির সাহেবের প্রতিই ছিল। o মধ্যাহ্নরৌদ্রে উত্তপ্ত বালুর উপর দিয়া চলিতে চলিতে । গোরা সমস্ত পথ একটি কথাও বলিল না।-অবশেষে । গাছপালার ভিতর হইতে কাছারিবাড়ির চালা ৰখন ছি | দূর হইতে দেখা গেল তখন হঠাৎ গোরা আসিয়া কহিল, “রমাপতি তুমি খেতে যাও, আমি সেই সাপিতের বাড়ি । চলুম।” - রমাপতি কহিল, “সে কি কথা ? আপনি খাবেন না ? চাটুজ্জের ওখানে খাওয়াদাওয়া করে তার পরে যাবেন।”