পাতা:প্রবাসী (অষ্টম ভাগ).pdf/১৩৬

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

২৩৬ বাংলার অভিমুখে আসিতেছে তখন আশঙ্কায় তাহার বুকের মধ্যে তোলাপাড়া করিতে লাগিল । বহু চেষ্টায় সে নিজেকে শান্ত করিয়া একটা বই হাতে করিয়া এ ঘরে আসিয়া বসিল। ললিতা শেলাই ভালবাসে না কিন্তু সে আজ চুপ করিয়া কোণে বসিয়া শেলাই করিতেছিল,— লাবণ্য সুধীরকে লইয়া ইংরেজি বানানের খেলা থেলিতেছিল, লীলা ছিল দর্শক ; হারান বাবু বরদাসুন্দরীর সঙ্গে আগামী কল্যকার উৎসবের কথা আলোচনা করিতেছিলেন । আজ প্রাতঃকালে পুলিসের সঙ্গে গোরার বিরোধের ইতিহাস বিনয় সমস্ত বিবৃত করিয়া বলিল। মুচরিতা স্তব্ধ হইয়া বসিয়া রহিল—ললিতার কোল হইতে শেলাই পড়িয়া গেল এবং তাহার মুখ লাল হইয়া উঠিল । বরদাসুন্দরী কহিলেন—“আপনি কিছু ভাববেন না বিনয় বাবু-আজ সন্ধ্যা বেলায় ম্যাজিষ্ট্রেট সাহেবের মেমের কাছে গৌরমোহনবাবুর জন্তে আমি নিজে অনুরোধ করব।” বিনয় কহিল—“না, আপনি তা করবেন না – গোর যদি শুনতে পায় তাহলে জীবনে সে আমাকে আর ক্ষম করবে না।” সুধীর কহিল—“র্তার ডিফেন্সের জঙ্গ ত কোনো বন্দোবস্ত করতে হবে ।” জামিন হইতে থালাসের চেষ্টা এবং উকিল নিয়োগ সম্বন্ধে গোরা যে সকল আপত্তি করিয়াছিল বিনয় তাহ সমস্তই বলিল—শুনিয়া হারান বাৰু অসহিষ্ণু হইয়া কহিলেন —“এ সমস্ত বাড়াবাড়ি !" হারান বাণুর প্রতি ললিতার মনের ভাব যাই থাক্ সে এ পর্য্যন্ত র্তাহাকে মান্ত করিয়া আসিয়াছে, কথনে তাহার সঙ্গে তর্কে যোগ দেয় নাই,—আজ সে তীব্রভাবে মাথ৷ নাড়িয়া বলিয়া উঠিল—“কিছুমাত্র বাড়াবাড়ি নয়—গেীর বাবু যা করেছেন সে ঠিক করেছেন—ম্যাজিষ্ট্রেট আমাদের জব্দ করবে আর আমরা নিজেরা নিজেকে রক্ষা করব । তাদের মোট মাইনে জোগাবার, জন্তে ট্যাক্স জোগাতে হবে, আবার তাদের হাত থেকে পরিত্রাণ পেতে উকীল ফি গাঠ থেকে দিতে হবে! এমন বিচার পাওয়ার চেয়ে জেলে যাওয়া ভাল!" ললিতাকে হারান বাবু এতটুকু দেখিয়াছেন—তাহার প্রবাসী । [ ৮ম ভাগ । যে একটা মতামত আছে সে কথা তিনি কোনোদিন কল্পনাও করেন নাই। সেই ললিতার মুথের তীব্র ভাষা গুনিয়া আশ্চৰ্য্য হইয়া গেলেন-—তাহাকে ভৎসনার স্বরে কহিলেন, “তুমি এ সব কথার কি বোঝ? যারা গোটাকতক বই মুখস্থ করে পাস করে সবে কলেজ থেকে বেরিয়ে এসেছে, যাদের কোনো ধৰ্ম্ম নেই ধারণা নেই, তাদের মুখ থেকে দায়িত্বহীন উন্মত্ত প্ৰলাপ শুনে তোমাদের মাথা ঘুরে যায়!”–এই বলিয়া গত কল্য সন্ধ্যার সময় গোরার সহিত ম্যাজিষ্ট্রেটের সাক্ষাৎ-বিবরণ এবং সে সম্বন্ধে হারান বাবুর সঙ্গে ম্যাজিষ্ট্রেটের আলাপের কথা বিবৃত করিলেন। চরঘোষপুরের ব্যাপার বিনয়ের জানা ছিল না ; শুনিয়া সে শঙ্কিত হইয়া উঠিল—বুঝিল ম্যাজিষ্ট্রেট গোরাকে সহজে ক্ষমা করিবে না। - হারান যে উদ্দেশ্যে এই গল্পটা বলিলেন তাহা সম্পূর্ণ ব্যর্থ হইয়া গেল। তিনি যে গোরার সহিত র্তাহার দেখা হওয়া সম্বন্ধে এতক্ষণ পর্য্যস্ত একেবারে নীরব ছিলেন তাহার ভিতরকার ক্ষুদ্রতা সুচরিতাকে আঘাত করিল এবং হারান বাবুর প্রত্যেক কথার মধ্যে গোরার প্রতি যে একটা ব্যক্তিগত ঈর্ষা প্রকাশ পাইল তাহাতে গোরার এই বিপদের দিনে তাহার প্রতি উপস্থিত প্রত্যেকেরই একটা অশ্রদ্ধা জন্মাইয়া দিল। স্বচরিতা এতক্ষণ চুপ করিয়াছিল ; কি একটা বলিবার জন্য তাহার আবেগ উপস্থিত হইল, কিন্তু সেটা সম্বরণ করিয়া সে বইয়ের পাতা খুলিয়া কম্পিত হন্তে উণ্টাইতে লাগিল। ললিত উদ্ধতভাবে কহিল, “ম্যাজিষ্ট্রেটের সহিত হারান বাবুর মতের যতই মিল থাক, ঘোষ পুরের ব্যাপারে গৌরমোহন বাবুর মহত্ব প্রকাশ পাইয়াছে।" צ(א আজ ছোটলাট আসিবেন বলিয়া ম্যাজিষ্ট্রেট ঠিক সাড়ে দশটায় আদালতে আসিয়া বিচারকার্য্য সকাল সকাল শেষ করিয়া ফেলিতে চেষ্টা করিলেন । সাতকড়ি বাবু ইস্কুলের ছাত্রদের পক্ষ লইয়া সেই উপলক্ষ্যে র্তাহার বন্ধুকে বাচাইবার চেষ্টা করিলেন। তিনি গতিক দেখিয়া বুঝিয়াছিলেন যে, অপরাধ স্বীকার করাই এ স্থলে ভাল চাল । ছেলেরা দুরন্ত হইয়াই থাকে, তাহার i গিয়া বয়স ও অপরাধের তারতম্য অনুসারে পাঁচ হইতে পশি বেতের আদেশ করিয়াছিলেন। গোরার উকীল কেহ ছিল না । সে নিজের মামলা নিজে চালাইবার উপলক্ষ্যে পুলিসের অত্যাচার সম্বন্ধে কিছু বলিবার চেষ্টা করিতেই ম্যাজিষ্ট্রেট তাহাকে তীব্র তিরস্কার করিয়া তাহার সুখ বন্ধ করিয়া দিলেন ও পুলিসের কৰ্ম্মে বাধা দেওয়া অপরাধে তাহাকে একমাস সশ্রম কারাদণ্ড দিলেন এবং এইরূপ লঘু দণ্ডকে বিশেষ দয়া বলিয়া কীৰ্ত্তন করিলেন। সুধীর ও বিনয় আদালতে উপস্থিত ছিল। বিনয় গোরার মুথের দিকে চাহিতে পারিল না। তাহার যেন নিঃশ্বাস বন্ধ হইবার উপক্রম হইল, সে তাড়াতাড়ি আদালত ঘর হইতে বাহির হইয়া আসিল । সুধীর তাহাকে ডাকবাংলায় ফিরিয়া গিয়া স্নানাহারের জন্য অনুরোধ করিল— সে শুনিল না—মাঠের রাস্ত দিয়া চলিতে চলিতে গাছের তলায় বসিয়া পড়িল। মুধীরকে কহিল, “তুমি বাংলায় ফিরিয়া যাও কিছুক্ষণ পরে আমি যাইব।” সুধীর চলিয়া গেল। - এমন করিয়া যে কতক্ষণ কাটিয়া গেল তাহা সে জানিতে পারিলন। স্বৰ্য্য মাথার উপর হইতে পশ্চিমের দিকে যখন হেলিয়াছে তখন একটা গাড়ি ঠিক তাহার সম্মুখে আসিয়া খামিল। বিনয় মুখ তুলিয়া দেখিল স্বধীর ও স্বচরিতা গাড়ি হইতে নামিয়া তাহার কাছে আসিতেছে। বিনয় তাড়াতাড়ি উঠিয়া দাড়াইল । স্বচরিত কাছে আসিয়া স্নেহাৰ্দ্ৰস্বরে কহিল, “বিনয় বাবু আমুন!” বিনয়ের হঠাৎ চৈতন্ত হইল যে এই দৃশ্রে রাস্তার লোকে কৌতুক অনুভব করিতেছে। সে তাড়াতাড়ি গাড়িতে উঠিয়া পড়িল। সমস্ত পথ কেহ কিছুই কথা কহিতে পারিলনা। ডাক বাংলায় পৌছিয়া বিনয় দেখিল সেখানে একটা লড়াই চলিতেছে। ললিত বাকিয়া বসিয়াছে সে কোনোমতেই আজ ম্যাজিষ্ট্রেটের নিমন্ত্রণে যোগ দিবেন। বরদাসুন্দরী বিষম সঙ্কটে পড়িয়া গিয়াছেন-হারান বাবু ললিতার মত বালিকার এই অসঙ্গত বিদ্রোহে ক্রোধে অস্থির হইয়া অৰ্ব্বাচীন নিৰ্ব্বোধ ইত্যাদি বলিয়া তাহীদের জন্য ক্ষম L উঠিয়াছেন। তিনি বারবার বলিতেছেন আজকালকার ছেলে ৫ম সংখ্যা । ] গোর। ২৩৭ | প্রার্থনা করিলেন। মজিষ্টেট ছাত্রদিকে জেলে লষ্টয়া মেয়েদের এ কিরূপ বিকার ঘটিয়াছে—তাহারা ডিসিপ্লিন মানিতে চাহে না । কেবল যে-সে লোকের সংসর্গে যাহতাহা আলোচনা করিয়াই এইরূপ ঘটিতেছে ! বিনয় আসিতেই ললিত কহিল—“বিনয় বাবু, আমাকে , মাপ করুন। আমি আপনার কাছে ভারি অপরাধ করেছি; আপনি তখন যা বলেছিলেন আমি কিছুই বুঝতে পারিনি ;–আমরা বাইরের অবস্থা কিছুই জানিনে বলেই এত ভুল বুঝি ! পাল্লুবাবু বলেন ভারতবর্ষে ম্যাজিষ্ট্রেটের এই শাসন বিধাতার বিধান—তা যদি হয় তবে এই শাসনকে সমস্ত কায়মনোবাক্যে অভিশাপ দেবার ইচ্ছা জাগিয়ে দেওয়াও সেই বিধাতারই বিধান!” হারান বাবু ক্রুদ্ধ হইয়া বলিতে লাগিলেন—“ললিতা, তুমি”— ললিতা হারান বাবুর দিক হইতে ফিরিয়া দাড়াইয়া কহিল, "চুপ করুন ! আপনাকে আমি কিছু বলচিনে! বিনয় বাবু, আপনি কারো অনুরোধ রাখবেন না! আজ কোনোমতেই অভিনয় হতেই পারে না ।” বরদাসুন্দরী তাড়াতাড়ি ললিতার কথা চাপা দিয়া কহিলেন—“ললিতা, তুই ত আচ্ছা মেয়ে দেখ চি! বিনয় বাবুকে আজ স্নান করতে খেতে দিবিনে ? বেলা দেড়ট বেজে গেছে তা জানিস্ ? দেখ দেখি ওঁর মুখ শুকিয়ে কি রকম চেহারা হয়ে গেছে !” বিনয় কহিল—“এখানে আমরা সেই ম্যাজিষ্ট্রেটের অতিথি—এবাড়িতে আমি স্নানাহার করতে পারবনা।” বরদাসুন্দর বিনয়কে বিস্তর মিনতি করিয়া বুঝাইতে চেষ্টা করিলেন। মেয়েরা সকলেই চুপ করিয়া আছে দেখিয়া তিনি রাগিয়া বলিলেন—“তোদের সব হল কি ? মুচি, তুমি বিনয় বাবুকে একটু বুঝিয়ে বলনা ! আমরা কথা দিয়েছি—লোকজন সব ডাকা হয়েছে, আজকের দিনটা কোনোমতে কাটিয়ে যেতে হবে—নইলে ওরা কি মনে করবে বল দেখি ? আর ষে ওদের সাম্ৰুে মুখ দেখাতে পারব না !” মুচরিতা চুপ করিয়া মুখ নীচু করিয়া বসিয়া রহিল। বিনয় অদূরে নদীতে ষ্টীমাৱে চলিয়া গেল। এই ষ্টীমার আজ ঘণ্টা কুয়েকের মধ্যেই যাত্রী লইয়া কলিকাতায় রওনা