পাতা:প্রবাসী (অষ্টম ভাগ).pdf/১৬৫

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

२४-४ পূর্ব ও পশ্চিম । ভারতবর্ষের ইতিহাস কাহাদের ইতিহাস ? একদিন যে শ্বেতকায় আৰ্য্যগণ প্রকৃতির এবং মানুষের সমস্ত দুরূহ বাধা ভেদ করিয়া ভারতবর্ষে প্রবেশ করিয়াছিলেন ; যে অন্ধকারময় স্ববিস্তীর্ণ অরণ্য এই বৃহৎ দেশকে আচ্ছন্ন করিয়া পূৰ্ব্বে পশ্চিমে প্রসারিত ছিল তাতাকে একটা নিবিড় যবনিকার মত সরাইয়া দিয়া ফলশহে বিচিত্র, আলোকময়,উন্মুক্ত রঙ্গভূমি উদঘাটিত করিয়া দিলেন ; তাহাদের বুদ্ধি, শক্তি ও সাধনা একদিন এই ইতিহাসের ভিত্তি রচনা করিয়াছিল। কিন্তু এ কথা তাহারা বলিতে পারেন নাই যে, ভারতবর্ষ আমাদেরই ভারতবর্ষ। আর্যারা অনার্যাদের সঙ্গে মিশিয়া গিয়াছিলেন । প্রথম যুগে আর্য্যদের প্রভাব যখন অক্ষুণ্ণ ছিল তখনো অনার্য্য শূদ্রদের সহিত তাহদের প্রতিলোম বিবাহ চলিতেছিল। তারপর বৌদ্ধযুগে এই মিশ্রণ আরো অবাধ হইয়া উঠিয়াছিল। এই যুগের অবসানে যখন হিন্দুসমাজ আপনার বেড়াগুলি পুনঃসংস্কার করতে প্রবৃত্ত হইল এবং খুব শক্ত পাথর দিয়া আপন প্রাচীর পাকা করিয়া গাঁথিতে চাহিল, তখন দেশের অনেক স্থলে এমন অবস্থা ঘটিাছিল যে, ক্রিয়াকৰ্ম্ম পালন করিবার জন্য বিশুদ্ধ ব্রাহ্মণ জিয়া পাওয়া কঠিন হইয়াছিল ; অনেক স্থলে ভিন্নদেশ হইতে ব্রাহ্মণ আমন্ত্ৰণ করিয়া আনিতে হইয়াছে, এবং অনেক স্থলে রাজাজ্ঞায় উপবীত পরাইয়া ব্রাহ্মণ রচনা করিতে হইয়াছে একথা প্রসিদ্ধ। বর্ণের যে শুভ্রতা লইয়া একদিন আর্যার গৌরব বোধ করিয়াছিলেন সে শুভ্রতা মলিন হইয়াছে ; এবং আর্য্যগণ শূদ্রদের সহিত মিশ্রিত হইয়া, তাহাদের পিবিধ আচার ও ধৰ্ম্ম, দেবতা ও পূজা প্রণালী গ্রহণ করিয়া, তাছাদিগকে সমাজের অন্তর্গত করিয়া লইয়া হিন্দুসমাজ বলিয়া এক সমাজ রচিত হইয়াছে ; বৈদিক সমাজের সহিত কেবল যে তাহার ঐক্স নাই তাহা নহে অনেক বিরোধও আছে । অতীতের সেই পর্কেই কি ভারতবর্ষের ইতিহাস দাড়ি টানিতে পারিয়াছে ? বিধাতা কি তাহাকে এ কথা বলিতে দিয়াছেন য়ে ভারতবর্ষের ইতিহাস হিন্দুর ইতিহাস ? হিন্দুর ভারতবর্ষে যখন রাজপুত রাজারা পরস্পর মারামারি প্রবাসী । [.৮ম ভাগ। কাটাকাট কবিয়া বীরত্বের আত্মঘাতী অভিমান প্রচারকনি ছিলেন, সেই সময়ে ভারতবর্ষের সেই বিচ্ছিন্নতার ফাক দি মুসলমান এদেশে প্রবেশ করিল, চারিদিকে ছড়াইয়া পঞ্জি এবং পুরুষানুক্রমে জন্মিয়া ও মরিয়া এদেশের মাটিকে আপন করিয়া লইল । যদি এইখানেই ছেদ দিয়া বলি, বাস, আর নয়= | ভারতবর্ষের ইতিহাসকে আমরা হিন্দুমুসলমানেরই ইতিহাস করিয়া তুলিব, তবে যে বিশ্বকৰ্ম্ম মানবসমাজকে সঙ্কীর্ণ কেন্তু হইতে ক্রমশই বৃহৎ পরিধির দিকে গড়িয়া তুলিতেছেন তিনি কি তাহার প্ল্যান বদলাইয়। আমাদেরই অহঙ্কায়ন্ধে সার্থক করিয়া তুলিবেন ? ভারতবর্ষ আমার হইবে কি তোমার হইবে, হিন্দু হইবে কি মুসলমানের হইবে, কি আর কোনো জাত আদি এখানে আধিপত্য করিবে, বিধাতার দরবারে যে সেই কথাটাই সবচেয়ে বড় করিয়া আলোচিত হইতেছে, তা নহে। তাহার আদালতে নানা পক্ষের উকীল নান পক্ষের দরখাস্ত লইয়া লড়াই করিতেছে। অবশেষে একদিন । মকদ্দমা শেষ হইলে পর হয় হিন্দু, নয় মুসলমান, ন ইংরেজ, নয় আর কোনো জাতি চূড়ান্ত ডিক্রি পাই৷ নিশান গাড়ি করিয়া বসিবে একথা সত্য নহে। আমরা মনে করি জগতে স্বত্বের লড়াই চলিতেছে, সেটা আমাদের অহঙ্কার ; লড়াই যা সে সত্যের লড়াই। যাহা সকলের চেয়ে শ্রেষ্ঠ, যাহা সকলের চেয়ে পূর্ণ যাহা চরম সত্য, তাহাই নানা আঘাত সংঘাতের মধ্য দিয়া হষ্টয়া উঠিবার দিকে চলিয়াছে,-আমাদের সমস্ত ইচ্ছ দিয়া তাহাকেই আমরা যে পরিমাণে অগ্রসর করিতে চেষ্ট৷ করিব সেই পরিমাণেই আমাদের চেষ্টা সার্থক হইবে: নিজেকেই ব্যক্তি হিসাবেই হউক আর জাতি হিসাবেই হউক্ত জয়ী করিবার যে চেষ্টা, বিশ্ববিধানের মধ্যে তাহার গুরুত্ব কিছুই নাই। গ্ৰীয়ের জয়পতাকা আলেকজাণ্ডারকে আশ্রয় করিয়া সমস্ত পৃথিবীকে যে একচ্ছত্র করিতে পারে নাই তাহাতে গ্রীসের দন্তই অকৃতাৰ্থ হইয়াছে—পৃথিবীতে আজ সে দম্ভের মূল্য কি ? রোমের বিশ্বসাম্রাজ্যের আয়োজন বৰ্ব্বরের সংঘাতে ফাটিয়া খান খান হইয়া সমস্ত যুরোপন যে বিকীর্ণ হইল তাহাতে রোমকের অহঙ্কার অসম্পূর্ণ ৫ম সংখ্যা । ] হইয়াছে কিন্তু সেই ক্ষতি লইয়া জগতে আজ কে বিলাপ করিবে ? গ্ৰীস এবং রোম মহাকালের সোনার তরীতে নিজের পাক ফসল সমস্তই বোঝাই করিয়া দিয়াছে ; কিন্তু তাহারা নিজেও সেই তরণীর স্থান আশ্রয় করিয়া আজ পর্যন্ত যে বসিয়া নাই তাহাতে কালের অনাবশ্বক ডার লাঘব করিয়াছে মাত্র, কোনো ক্ষতি করে নাই। ভারতবর্ষেও যে ইতিহাস গঠিত হইয়া উঠিতেছে এ ইতিহাসের শেষ তাৎপৰ্য্য এ নয় যে, এদেশে হিন্দুই বড় হুইবে বা আর কেহ বড় হইবে। ভারতবর্যে মানবের ইতিহাস একটি বিশেষ সার্থকতার মূৰ্ত্তি পরিগ্রহ করিবে, পরিপূর্ণতাকে একটি অপূৰ্ব্ব আকার দান করিয়া তাহাকে সমস্ত মানবের সামগ্ৰী করিয়া তুলিবে ;–ইহা অপেক্ষা কোনো ক্ষুদ্র অভিপ্রায় ভারতবর্ষের ইতিহাসে নাই। এই পরিপূর্ণতার প্রতিমা গঠনে হিন্দু, মুসলমান বা ইংরেজ যদি নিজের বর্তমান বিশেষ আকারটিকে একবারে বিলুপ্ত করিয়া দেয়, তাহাতে স্বাজাতিক অভিমানের অপমৃত্যু ঘটতে পারে কিন্তু সত্যের বা মঙ্গলের অপচয় হয় না। আমরা বৃহৎ ভারতবর্ষকে গড়িয়া তুলিবার জন্য আছি। আমরা তাহার একটা উপকরণ । কিন্তু উপকরণ যদি এই বলিয়া বিদ্রোহ প্রকাশ করিতে থাকে যে আমরাই চরম, আমরা সমগ্রেব সঙ্গিত মিলিব না, আমরা স্বতন্ত্র থাকিব, তবে সকল হিসাবেই ব্যর্থ হয়। বিরাট রচনার সহিত যে থও সামগ্ৰী কোনো মতেই মিশ থাইবে না, যে বলিবে আমিই টিকিতে চাই, সে একদিন বাদ পড়িয়া যাইবে। যে বলিবে আমি স্বয়ং কিছুই নই, যে সমগ্র রচিত হইতেছে তাহারই উদ্দেশে আমি সম্পূর্ণভাবে উৎকৃষ্ট ক্ষুদ্রকে সেই ত্যাগ করিয়া বৃহতের মধ্যে রক্ষিত হইবে। ভারতবর্ষেরও যে অংশ সমস্তের সহিত নিলিতে চাহিবেনা, যাহা কোনো একটা বিশেষ অতীত কালের অন্তরালের মধ্যে প্রচ্ছন্ন থাকিয়া অন্ত সকলের হইতে বিচ্ছিন্ন হইয়া থাকিতে চাহিবে, যে আপনার চারিদিকে কেবল বাধা রচনা করিয়া তুলিবে, ভারত ইতিহাসের বিধাতা তাহাকে আঘাতের পর আঘাতে, হয় পরম দুঃখ সকলের সঙ্গে সমান করিয়া দিবেন নয় তাহাকে অনাবশ্যক ব্যাঘাত বলিয়৷ একেবারে বর্জন করিবেন। কারণ, ভারতবর্ষের by পূর্ব ও পশ্চিম। Rbrs) ইতিহাস আমাদেরই ইতিহাস নহে, আমরাই ভারতবর্ষের ইতিহাসের জন্ত সমাঙ্গত ; আমরা নিজেকে যদি তাহার যোগ্য না করি তবে আমরাই নষ্ট হইব। আমরা সৰ্ব্বপ্রকারে সকলের সংস্রব বাচাইয়া অতি বিশুদ্ধভাবে স্বতন্ত্র থাকিব এই বলিয়া . যদি গৌরব করি এবং যদি মনে করি এই গৌরবকেই আমাদের বংশপরম্পরায় চিরন্তন করিয়া রাখিবার ভার আমাদের ইতিহাস গ্রহণ করিয়াছে, যদি মনে করি আমাদের ধৰ্ম্ম কেবলমাত্র আমাদেরই, আমাদের আচার বিশেষ ভাবে আমাদেরই, আমাদের পূজাক্ষেত্রে আর কেহ পদার্পণ করিবেন, আমাদের জ্ঞান কেবল আমাদেরই লৌহপেটকে আবদ্ধ থাকিবে, তবে না জানিয়া আমরা এই কথাই বলি ষে বিশ্বসমাজে আমাদের মৃত্যুদণ্ডের আদেশ হইয়া আছে, এক্ষণে তাহারই জন্ত আত্মরচিত কারাগারে অপেক্ষা করিতেছি। সম্প্রতি পশ্চিম হইতে ইংরেজ আসিয়া ভারতবর্ষের ইতিহাসের একটি প্রধান স্থান অধিকার করিয়াছে। এই ঘটনা অনাহূত আকস্মিক নহে। পশ্চিমের সংস্রব হইতে বঞ্চিত হইলে ভারতবর্ষ সম্পূর্ণত হইতে বঞ্চিত হইত। যুরোপের প্রদীপের মুখে শিখা এখন জলিতেছে। সেই শিথা হইতে আমাদের প্রদীপ জালাইয়া লইয়া আমাদিগকে কালের পথে আর একবার যাত্রা করিয়া বাহির হইতে হইবে। বিশ্বজগতে আমরা যাহা পাইতে পারি, তিন হাজার বৎসর পূৰ্ব্বেই আমাদের পিতামহেরা তাহ সমস্তই সঞ্চয় করিয়া চুকাইয়া দিয়াছেন, আমরা এমন হতভাগ্য নহি এবং জগৎ এত দরিদ্র নহে ; আমরা যাহা করিতে পারি, তাহা আমাদের পূৰ্ব্বেই করা হইয়া গেছে, এ কথা যদি সত্য হয়, তবে জগতের কৰ্ম্মক্ষেত্রে আমাদের প্রকাও অনাবশুকতা লইয়া আমরা ত পৃথিবীর ভার হইয়া থাকিতে পারিব না। যাহারা প্রপিতামহদের মধ্যেই নিজেকে সৰ্ব্বপ্রকারে সমাপ্ত বলিয়া জানে, এবং সমস্ত বিশ্বাস এবং আচারের দ্বারা আধুনিকের সংস্পর্শ হইতে নিজেকে বাচাইয়া চলিতে চেষ্টা করে, তাহারা নিজেকে বাচাইয়ী রাখিবে কোন বর্তমানের তাড়নায়, কোন ভবিষ্যতের আশ্বাসে ? পৃথিবীতে আমাদেরও যে প্রয়োজন আছে, সে প্রয়োজন আমাদের - নিজের ক্ষুদ্রতার মধ্যেই বদ্ধ নহে, তাহা নিখিল মানুষের