পাতা:প্রবাসী (অষ্টম ভাগ).pdf/২২২

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

পক্ষে একেবারে অসম্ভব। বর্তমান শিক্ষা প্রণালীর সমালোচনা অত্যন্ত সংক্ষেপে সারিলাম। এক্ষণে আমি যে প্রণালী অমুসরণ করিয়া কিঞ্চিৎ ফললাভ করিয়াছি তাহার কিছু পরিচয় দিবার চেষ্টা করিব। আপনাদের ধৈর্যাচুতির আশঙ্কায় ইহাও যথাসাধ্য সংক্ষেপ করিব । আজকাল যে সমস্ত বিষয় সাধারণ পাঠশালায় শিক্ষা দেওয়া হইয়া থাকে, প্রথমতঃ সেই সমস্ত বিষয় অবলম্বন করিয়াই আমার বক্তব্য বলিব। বাংলা লেখা ও পড়া সম্বন্ধে কোনো কথা বলিবার পূৰ্ব্বে ভাষাশিক্ষা সম্বন্ধে একটা সাধারণ কথা মানিয়া লওয়া আবশুক। সেটি এই যে ভাষা শিক্ষাকালে আগে ব্যবহৃত হয় ‘কান তারপরে ‘জিব’ পরে ‘চক্ষু’ এবং সৰ্ব্বশেষে ‘হাত’। এটি যে সম্পূর্ণ বিজ্ঞানসম্মত প্রণালী তাহ বোধ হয় আপনার কেহই অস্বীকার করিবেন না। আমি অন্ততঃ এটিকে ভাষা শিক্ষার মূলমন্ত্র বলিয়া গণ্য করি। বাংলা আমাদের মাতৃভাষা বলিয়া কান ও জিবের কাজটা কথাবার্তার দ্বারা আপন আপনিই হইয়া আসে। কাজেই বাংলা শিক্ষাট আরম্ভ করিতে হইবে চক্ষু দিয়া। এইখানেই বর্তমান প্রণালীর বিরুদ্ধে আমার প্রথম নম্বরের নালিশ। ইহাতে হাতের কাজ চোখের আগেই হইয়া থাকে অর্থাৎ অক্ষর চেনার আগেই লেখা আরম্ভ হয়। প্রথমে পড়া আরম্ভ করিতে হইলে আগে অক্ষর চেনা দরকার, কিন্তু এই অক্ষর চেনা ব্যাপারটা যে অত্যন্ত নীরস ! ইহাকে একটু সরস করিয়া তুলিবার জন্য আমি এটাকে খেলার আকার দিতে চেষ্টা করিয়াছি। শিক্ষক এবং ছাত্রের হাতে এক জোড়া করিয়া বর্ণমালার তাস থাকিবে, শিক্ষক তাহার তাস হইতে একখানি লইয়া ছাত্রের সামনে রাথিবেন এবং তাহার অনুরূপ তাস থানি ছাত্রকে বাছিয়া বাছিয়া বাহির করিতে বলিবেন। ছাত্র যদি ঠিক্ তাসখানি বাহির করিতে পারিল তবে তার জিত হইল আর তা না পারিলে আবার চেষ্টা করিতে দেওয়া যাইবে। এইরূপে যখন আস্তে আস্তে অক্ষরগুলির চেহার মাথায় এক রকম বসিয়া গেল তখন অক্ষরের নাম শেখানো যাইতে পারে। এই প্রণালীতে আমি অল্প সময়ের মধ্যেই সহজে ছেলেদের অক্ষর পরিচয় হইতে দেখিয়াছি। অক্ষর পরিচর হবার পর বই ধরাইতে হইবে। আমি যতগুলি বই দেখিাছি তাহার মধ্যে রামানন্দ বাবুর বর্ণপরিচয়কেই প্রবাসী । - সৰ্ব্বোৎকৃষ্ট বলিয়া বাছিয়া লইয়াছি। দুধের दिषग्न आशत | পুৰ্ব্ববঙ্গ রামসুন্দর বসাকের এবং পশ্চিমবঙ্গ বিদ্যাসাগর মহাশয়ের মায়া এখনো কাটাইয়া উঠিতে পারে নাই। বর্ণপরিচয় প্রথম ও দ্বিতীয় ভাগ শেষ করিয়াই আজ কাল ছেলেরা বিজ্ঞান-রীডার নামক এক কিভূত-কিমাকার বই ধরে, তাহাতে না হয় বিজ্ঞান শিক্ষা—কারণ বিজ্ঞানক্ষে বইয়ের জিনিস করিয়া তুলিলেই তাহার জাত মারা হয়-ন হয় ভাষাশিক্ষা। এই সমস্ত পুস্তকের অভিনব বাংলা মুকুমার মতি বালকদের পক্ষে দস্তস্ফুট করাই কঠিন। আমার মান হয় বানানটা শেষ হইলেই শাদা-কথায়-লেখা কোনো গল্পের বই ছেলেদের পড়িতে দেওয়া উচিত। ইহাতে যেমন একদিকে তাহাদের গল্পের তৃষ্ণ মিটিবে তেমনি অন্যদিকে সুললিত ভাষার সঙ্গে পরিচয় সাধন হইতে থাকিবে। লেখা—লেখা শিথাইবার জন্য আমি বাংলা বর্ণমালার আকার সাদৃশ্ব অনুসারে কয়েকটা শ্রেণী তৈরি করির লইয়াছি যথা—‘ব’ শ্রেণী-ইহাতে ব, র, ক, খ, ক, ৰ এই কয়টি প্রায় একই চেহারার অক্ষর আছে। ইহা একটিকে আয়ত্ত করিতে পারিলেই আর সবগুলি লেখ । অত্যন্ত সহজ হইয়া পড়ে। এই প্রণালী অনুসারে লেখা শেখাইয়া আমি বেশ ফল পাইয়াছি। অক্ষর যখন কিছু কিছু লিখিতে শিথিল তখন হইতেই ছোট খাট শব্দ লিখিড়ে দেওয়া উচিত। ক্রমে ক্রমে বানান ও ফল আনিয়া যোগ করিতে হইবে। তার পরে গণিত। গণিত সম্বন্ধে কিছু বলা আমার পক্ষে ধৃষ্টতা মাত্র ; তবু প্রবন্ধের অঙ্গহানির আশঙ্কায় দুই এক কং বলিতে হয়। এ সম্বন্ধে বর্তমান প্রণালীর বিরুদ্ধে আমার প্রধান অভিযোগ এই যে ইহাতে গণিত ব্যাপারটাকে অত্যন্ত abstract অর্থাৎ জড় পদার্থের সহিত সম্বন্ধ হীন করিয়া তোলা হয়। বস্তুবিষয়ের সঙ্গে না মিলাইয়া আমরা রে কোনো জ্ঞান লাভ করি তাহাই অসম্পূর্ণ। গণিত শিক্ষাকে যদি কাৰ্য্যকরী করিতে হয় তাহা হইলে ইহাকে ইঞ্জিয় গ্ৰাহ বস্তুর সাহায্যে আয়ত্ত করিতে হইবে। আমার নিয়মে ছেলেরা বকুলবীচি, বাশ, টপাত প্রভৃতির সাহায্যে গুণিতে শেথে —তার পরে উহাদেখি সাহায্যে ছোট ছোট যোগ বিয়োগ শেখে। ক্রমে অধিক [ ৮ম ভাগ। | ৭ম সংখ্যা । ] BB eeMeeMSJJJSMSMSMMS - সংখ্যার যোগ বিয়োগে অগ্রসর হয় । ইহার পর স্থানীয় মানটা বোঝাইয়া লেখা ধরাইয়া দি। অন্ধ সম্বন্ধে আর কিছু বলিয়া আপনাদের বিরক্তি উৎপাদন করিব না। আজকালকার পাঠশালায় লেখা, পড়া এবং গণিত ছাড়া আর কোনো বিষয়ই শেখানো হয় না। কিন্তু অন্তান্ত সভ্যদেশের প্রাথমিক শিক্ষার মধ্যে কিছু কিছু বিজ্ঞান, ইতিহাস ভূগোলও স্থান পাইয়াছে। ইহাতে তাহদের শিশুরা কেবল যে জড় ভাবে মুখস্থ করে তাহা নহে, নিজের চোখ কান বুদ্ধিবৃত্তিকে স্বাধীন ভাবে খাটাইতে পায়। আমাদের এখানেও তাহাই করা উচিত, কিন্তু" গোড়ায় যে গলদ ! সে শিক্ষক কোথায় যিনি স্বদেশেতিহাসের সজীবমূৰ্ত্তি ছেলেদের সমূথে ধরিবেন, যিনি আমাদের দৃশ্যমান জগতের উপরে বিজ্ঞানের আলোক নিক্ষেপ করিবেন—যিনি গিরি নদী কানন সমুদ্র অধিষ্ঠিত এই বসুন্ধরাকে শিশুদের চক্ষের সম্মুখে প্রসারিত করিয়া দিবেন ? এ রকম শিক্ষক দুর্লভ বটে কিন্তু সম্পূর্ণতার প্রতি লক্ষ্য রাখিলে এই সব অত্যাবশ্বক জিনিসকে ত বাদ দেওয়া চলে না। এই ভাবিয়াই আমি আমার বিদ্যালয়ে যথাসাধ্য একটু বিজ্ঞানের স্থান করিয়া য়িছি এবং ভবিষ্যতে ইতিহাস ও ভূগোল শিক্ষা দিবারও আশা রাখি । বিলাতে নৈতিক শিক্ষা বলিয়া একটা ব্যাপার প্রচলিত আছে। আমাদের দেশেও সে জিনিসটা ক্রমে ক্রমে প্রবেশ করিতেছে, তবে এখনো পাঠশালা পৰ্য্যস্ত গিয়া পৌছায় নাই। যদি পাঠশালার মধ্যেও ইহার স্থান করিতে হয় তবে যেন ইহাকে অন্য জায়গার মত নীরস করিয়া তোলা না হয়, আমাদের দেশের অক্ষয় ভাণ্ডার রামায়ণ ও মহাভারতের ভিতর দিয়া ছেলেরা যেন গল্পের মাধুর্য্য, সাহিত্যের রস এবং নৈতিক শিক্ষা একই সঙ্গে উপভোগ করিতে পারে। এতক্ষণ পৰ্য্যন্ত বাংলাদেশের শিশুসম্প্রদায়কেই সামনে রাখিয়া আমার বক্তব্য বলিয়াছি। কিন্তু অশিক্ষিত বলিতে কেবল ত শিশু বোঝায় না। আমাদের দেশের অধিক বয়স্ক মেয়ে পুরুষও ত অনেকেই অশিক্ষিত, তাদের ত আর "শালায় যাবার সময় নাই, তাদের ব্যবস্থা কি হইবে ? আমার মনে হয় অধিক বয়স্ক পুরুষদের জন্ত নাইট্র-স্কুল w প্রাথমিক শিক্ষা। ’ ○、○ স্থাপন করা দরকার। যদিও এ বিষয়ে গভর্মেন্ট ও ক্রীশ্চিয়ান । পাদ্রীরা কিছু কিছু কাজ করিতেছেন বটে, তবুও এত বড় দেশের পক্ষে তাহা যথেষ্ট নয়। এদিকে সমাজের দৃষ্টি দেওয়া দরকার । আমাদের সমাজের যেরূপ অবস্থা তাঁহাতে সাধারণ পাঠশালায় স্ত্রীশিক্ষার কোনো ব্যবস্থ হওয়া অসম্ভব। কাজেই বাড়ীতে বসিয়া যাতে তারা কিছু শিখিতে পারেন তার বন্দোবস্ত করিয়া দেওয়া উচিত। কিন্তু সকল পরিবারেই ত শেখাবার মত লোক থাকে না এবং সকলেই ত মাহিনা করিয়া স্ত্রীশিক্ষক রাথিতে পারে না। । আমার মনে হয় এই সব স্থলে অন্ততঃ ভদ্রপল্লীসমূহে একটা উপায় অবলম্বন করা যাইতে পারে। আপনার সকলেই জানেন যে আমাদের দেশের স্ত্রীলোকেরা বাড়ীর কাজ কৰ্ম্ম সারিয়া অনেক সময়ে একত্র সমবেত হন। এই সময়ে তাদের মধ্যে র্যারা একটু শিক্ষিত তারা যদি অন্তকে কিছু কিছু করিয়া সাহায্য করেন, তাহা হইলে কতকটা উপকার হইতে পারে। আমি জানি এইরূপে আমাদের গ্রামের অনেক স্ত্রীলোক কাজ চালানো রকমের লেখা পড়া শিথিয়াছে। এই কাজে বিধবা স্ত্রীলোকদের নিযুক্ত করা যাইতে পারে, ইহাতে একদিকে যেমন তাহদের কাজে কৰ্ম্মে অন্যমনস্ক রাখিবে তেমনি অন্যদিকে মঙ্গলকৰ্ম্মের গৌরব তাহাদের ব্রহ্মচৰ্য্যকে সার্থক করিবে । তবে এইখানে শেষ করি। আমার মোট কথা এই যে বাংলা দেশের শিশুশিক্ষার সংস্কার করিতে হইলে প্রাচীন গুরু মহাশয়দের স্থলে শিক্ষিত ভদ্র সস্তানকে বসাইতে হইবে এবং সমাজকেও তাহার অমুকুল হইতে হইবে। শিক্ষাপ্রণালীকে পূৰ্ব্ব সংস্কার হইতে মুক্ত করিয়া ইহার মধ্যে নূতন প্রাণ প্রতিষ্ঠা করিতে হইবে, অধিক বয়স্ক মেয়ে - পুরুষদের শিক্ষার জন্ত নাইট-স্কুল স্থাপন এবং বিধবাদের নিয়োগ করিতে হইবে। এইরূপে শিক্ষাকে বিস্তৃত করিলেই শিক্ষিত অশিক্ষিতের মধ্যের বিচ্ছেদসমুদ্র আপন আপনি বুজিয়া আসিবে এবং বাংলাদেশের হৃদয়ের মধ্য দিয়া এমন একটি রাস্তা প্রস্তুত হইবে যাহা ধরিয়া একদিন “স্বরাজে' উত্তীর্ণ হইতে পারিব। - - ঐযতীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়।