পাতা:প্রবাসী (অষ্টম ভাগ).pdf/২৩৮

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

8〉b" টানিতে লাগিল। স্নচরিতাকে গিয়া সে কহিল--"দিদি, তুমি বাবার সঙ্গে যাও। আমি যাব না।” স্বচরিতা কছিল, “সে কি হয়! তুই না গেলে আমি একলা যেতে পারব না। লক্ষ্মী আমার, ভাই আমার— চল ভাই, গোল করিস নে!” অনেক অমুনয়ে ললিতা গেল - কিন্তু বিনয়ের কাছে সে যে পরাস্ত হইয়াছে ; বিনয় অনায়াসেই তাহদের বাড়ি না আসিয়া পারিল, আর, সে আজ বিনয়কে দেখিতে ছুটিয়াছে এই পরাভবের অপমানে তাহার বিষম একটা রাগ হইতে লাগিল । বিনয়কে এখানে দেখিতে পাইবার আশাতেই আনন্দময়ীর বাড়ি আসিবার জন্য যে তাহার এতটা আগ্রহ জন্মিয়াছিল, এই কথাটা সে মনে মনে একেবারে অস্বীকার করিবার চেষ্টা করিতে লাগিল এবং নিজের সেই জিদ বজায় রাখিবার জন্ত, না বিনয়ের দিকে তাকাইল, না তাহার নমস্কার ফিরাইয়া দিল, না তাহার সঙ্গে একটা কথা কহিল। বিনয় মনে করিল, ললিতার কাছে তাহার মনের গোপন কথাটা ধরা পড়িয়াছে বলিয়াই সে অবজ্ঞার দ্বারা তাহাকে এমন করিয়া প্রত্যাখ্যান করিতেছে। ললিতা যে তাহাকে ভালবাসিতেও পারে একথা অনুমান করিবার উপযুক্ত আত্মাভিমান বিনয়ের ছিল না। বিনয় আসিয়া সঙ্কোচে দরজার কাছে দাড়াইয়া কহিল, “পরেশ বাবু এখন বাড়ি যেতে চাচ্চেন, এদের সকলকে খবর দিতে বল্পেন।” ললিত যাহাতে তাহাকে না দেখিতে পায় এমন করিয়াই বিনয় দাড়াইয়াছিল। আনন্দময়ী কহিলেন “সে কি হয় ! কিছু মিষ্টিমুখ না করে বুঝি যেতে পাবেন! আর বেশি দেরি হবে না। তুমি এখানে একটু বোস বিনয়, আমি একবার দেখে আসি । বাইরে দাড়িয়ে রইলে কেন, ঘরের মধ্যে এসে বোস ।” বিনয় ললিতার দিকে আড় করিয়া কোনোমতে দূরে এক জায়গায় বসিল । যেন বিনয়ের প্রতি তাহার ব্যবহারের কোনো বৈলক্ষণ্য হয় নাই এমনি সহজভাবে ললিতা কহিল “বিনয় বাবু, আপনার বন্ধু সতীশকে আপনি একেবারে ত্যাগ করেচেন কি না জানবার জন্তে সে আজ সকালে আপনার বাড়ি গিয়েছিল যে !" প্রবাসী । [ ৮ম ভাগ । হঠাৎ দৈববাণী হইলে মানুষ যেমন আশ্চৰ্য্য হইয়া যায় সেইরূপ বিস্ময়ে বিনয় চমকিয়া উঠিল। তাহার সেই চমকটা দেখা গেল বলিয়া সে অত্যন্ত লজ্জিত হইল। তাহার স্বভাবসিদ্ধ নৈপুণ্যের সঙ্গে কোনো জবাব করিতে পারিল না ; মুখ ও কর্ণমূল লাল করিয়া কহিল—“সতীশ গিয়েছিল না কি ! আমিত বাড়িতে ছিলুম না।” ললিতার এই সামান্য একটা কথায় বিনয়ের মনে একটা অপরিমিত আনন্দ জন্মিল একমুহূর্তে বিশ্বজগতের উপর হইতে একটা প্রকাও সংশয় যেন নিশ্বাসরোধকর দুঃস্বপ্নের মত দূর হইয় গেল। যেন এইটুকু ছাড়া পৃথিবীতে তাহার কাছে প্রার্থনীয় আর কিছু ছিল না। তাহার মন বলিতে লাগিল, “বাচিলাম,” “র্বাচিলাম!” ললিতা রাগ করে নাই, ললিতা তাহার প্রতি কোনো সন্দেহ করিতেছে না। দেখিতে সমস্ত বাধা কাটিয়া গেল। স্বচরিতা হাসিয়া কহিল—“বিনয় বাবু হঠাৎ আমাদের নর্থী দন্তী শৃঙ্গী অন্ত্র পাণি কিম্বা ঐরকম একটা কিছু বলে সন্দেহ করে বসেচেন ।” বিনয় কহিল—“পৃথিবীতে যারা মুখ ফুটে নালিশ করতে পারে না, চুপ করে থাকে তারাই উল্টে আসামী হয়। দিদি, তোমার মুখে একথা শোভা পায় না,-তুমি নিজে কতদূরে চলে গিয়েছ এখন অন্তকে দূর বলে মনে করচ।” বিনয় আজ প্রথম মুচরিতাকে দিদি বলিল। স্বচরিতার কানে তাহা মিষ্ট লাগিল। বিনয়ের প্রতি প্রথম পরিচয় হইতেই স্বচরিতার যে একটি সৌহৃদ্য জন্মিয়াছিল এই দিদি সম্বোধনমাত্রেই তাহা যেন একটি স্নেহপূর্ণ বিশেষ আকার ধারণ করিল। পরেশ বাবু তাহার মেয়েদের লইয়া যখন বিদায় হইয় গেলেন তখন দিন প্রায় শেষ হইয় গেছে। বিন আনন্দময়ীকে কহিল, “মা, আজ তোমাকে কোনো কাজ করতে দেব না। চল উপরের ঘরে।" বিনয় তাহার চিত্তের উদ্বেলতা সম্বরণ করিতে পারিক্তেছিল না। আনন্দময়ীকে উপরের ঘরে লইয়া গিয়া মেঝের উপরে নিজের হাতে মাছর পাতিয়া তাহাকে বসাইল। আনন্দময়ী বিনয়কে জিজ্ঞাসা করিলেন—“বিহু, কি, তোর কথাটা কি ?” | o | ৮ম সংখ্যা । ] নি কহিল, "আমার কোনাে কথা নেই, তুমি কথা বল!” পরেশ বাবুর মেয়েদিগকে আনন্দময়ীর কেমন লাগিল সেই কথা শুনিবার জন্যই বিনয়ের মন ছট্‌ফট্‌ করিতেছিল। . আনন্দময়ী কছিলেন, “বেশ, এই জন্যে তুই বুঝি আমাকে ডেকে আনলি! আমি বলি, বুঝি কোনো কথা स्रोप्झ ।” বিনয় কহিল, “ন ডেকে আনলে এমন স্বৰ্য্যাস্তটিত দেখতে পেতে না।” সেদিন কলিকাতার ছাদগুলির উপরে অগ্রহায়ণের স্বৰ্য মলিনভাবেই অস্ত যাইতেছিল –বর্ণচ্ছটার কোনো বৈচিত্র্য ছিল না-আকাশের প্রান্তে ধূমলবর্ণের বাপের মধ্যে সোণার আভা অস্পষ্ট হইয়া জড়াইয়াছিল। কিন্তু এই স্নান সন্ধার ধূসরতাও আজ বিনয়ের মনকে রাঙাইয়া তুলিয়াছে। তাহার মনে হইতে লাগিল, চারিদিক তাহাকে যেন নিবিড় করিয়া ঘিরিয়াছে আকাশ তাহাকে যেন স্পর্শ করিতেছে । আনন্দময়ী কছিলেন, “মেয়ে দুটি বড় লক্ষ্মী!” বিনয় এই কথাটাকে থামিতে দিল না। নানা দিক দিয়া এই আলোচনাকে জাগ্রত করিয়া রাখিল। পরেশ বাবুর মেয়েদের সম্বন্ধে কত দিনকার কত ছোটখাট ঘটনার কথা উঠিয়া পড়িল—তাহার অনেকগুলিই অকিঞ্চিৎকর কিন্তু সেই অগ্রহায়ণের স্নায়মান নিভৃত সন্ধ্যায় নিরালাঘরে বিনয়ের উৎসাহ এবং আনন্দময়ীর ঔৎসুক্য দ্বারা এই সকল ক্ষুদ্র গৃহকোণের অখ্যাত ইতিহাসখও একটি গম্ভীর মহিমায় পূর্ণ হইয়া উঠিল। আনন্দময়ী হঠাৎ এক সময়ে নিঃশ্বাস ফেলিয়া বলিয়া উঠিলেন, “স্বচরিতার সঙ্গে যদি গোরার বিয়ে হতে পারে ত বড় খুসি হই।” বিনয় লাফাইয়া উঠিল, কহিল, “ম, এ কথা আমি অনেক বার ভেবেছি ! ঠিক গোরার উপযুক্ত সঙ্গিনী !” আনন্দময়ী। কিন্তু হবে কি ? বিনয়। কেন হবে না ? আমার মনে হয় গোরা যে মুচরিতাকে পছন্দ করে না তা নয়- - গোরার মন যে কোনো একজায়গায় আকৃষ্ট হইয়াছে গোরা । 8>సి আনন্দময়ীর কাছে তাহ অগোচর ছিল না। সে মেয়েটি যে স্বচরিতা তাহাও তিনি বিনয়ের নানা কথা হইতে সংগ্ৰহ করিয়াছিলেন। খানিকক্ষণ চুপ করিয়া থাকিয়া আনন্দময়ী কহিলেন, “কিন্তু স্বচরিতা কি হিন্দুর ঘরে বিয়ে করবে ?” বিনয় কহিল, “আচ্ছা মা, গোরা কি ব্রাহ্মর ঘরে বিয়ে করতে পারে না ? তোমার কি তাতে মত নেই ?” . আনন্দময়ী। আমার খুব মত আছে। বিনয় পুনশ্চ জিজ্ঞাসা করিল, “আছে ?” আনন্দময়ী কহিলেন, “আছে বৈ কি বিমু ! মানুষের সঙ্গে মানুষের মনের মিল নিয়েই বিয়ে,—সে সময়ে কোন মন্তরটা পড়া হল তা নিয়ে কি আসে যায় বাবা! যেমন করে হো ভগবানের নামটা নিলেই হল!” বিনয়ের মনের ভিতর হইতে একটা ভার নামিয়৷ গেল। সে উৎসাহিত হইয়া কহিল, “মা, তোমার মুখে যখন এ সব কথা শুনি আমার ভারি আশ্চৰ্য্য বোধ হয় ! এমন ঔদার্য্য তুমি পেলে কোথা থেকে।” আনন্দময়ী হাসিয়া কহিলেন, “গোরার কাছ থেকে পেয়েছি।” বিনয় কছিল, “গোরা ত এর উণ্টো কথাই বলে!” আনন্দময়ী। বল্পে কি হবে! আমার যা কিছু শিক্ষা সব গোরা থেকেই হয়েচে । মানুষ বস্তুটি যে কত সত্য আর মানুষ যা নিয়ে দলাদলি করে, ঝগড়া করে’ মরে, তা যে কত মিথ্যে, সে কথা, ভগবান গোরাকে যে দিন দিয়েচেন সেই দিনই বুঝিয়ে দিয়েচেন। বাবা, ব্রাহ্মই বা কে, আর হিন্দুই বা কে ! মানুষের হৃদরে ত কোনো জাত নেই—সেই থানেই ভগবান সকলকে মেলান এবং. নিজে এসেও মেলেন ;–তাকে ঠেলে দ্বিয়ে মস্তর আর মতের উপরেই মেলাবার ভার দিলে চলে কি ?” বিনয় আনন্দময়ীর পায়ের ধূলা লইয়া কছিল, “ম, তোমার কথা আমার বড় মিষ্ট লাগল! আমার দিনটা আজ সার্থক হয়েচে ।” - ঐরবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।