পাতা:প্রবাসী (অষ্টম ভাগ).pdf/২৯

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

অতিক্রম করিয়া মনুষ্যত্বে আসিয়া পৌছিয়াছে এবং ইহারই শক্তিতে দেবত্বের দিকে অগ্রসর হইতেছে। কিন্তু হায়, মানুষের এমনও দুর্ভাগ্য যে, মানুষ সৌন্দর্য্যের মধ্যে সৌন্দৰ্য্যময়কে না দেখিয়া, উহার ভিতর আপনার মুখপূহ পরিতৃপ্তির উপকরণই খুজিয়া বেড়ায় ! প্রেমের আকর্ষণে প্রিয়তম দেবতার অভিমুখে না গিয়া, বাসনার মায়া কুহকেই আচ্ছন্ন হইয়া পড়ে ! কিন্তু ভক্ত ঐ সকল বাসনা-জালে আবদ্ধ প্রবৃত্তিপরায়ণ অবিশ্বাসী লোকের সন্মুখ দিয়াই, সৌন্দৰ্য্য ও প্রেমের আকর্ষণে ঈশ্বরের সম্মুখে গিয়া উপনীত হন এবং ভূমানন্দ লাভ করেন। ভক্ত ও কবির বিষয় মোটামুটি এক রকম বর্ণনা করা গেল। এখন ভক্ত ও কবির মধ্যে পার্থক্য কি, তাহাই নির্দেশ করিব। পূর্বেই বলিয়াছি, ভক্ত ও কবি দুজনই সৌন্দৰ্য্য ও ভাবের উপাসক। কিন্তু তাহা হইলেও উভয়ের মধ্যে পার্থক্য আছে। কবি সৌন্দৰ্য্য ও ভাবের নদীতে কল্পনার তরণী ভাসাইয়া, দুই তীরে জগতের রূপ, রস, শব্দ, গন্ধের কত বিচিত্র লীলা,—স্নেহ, প্রতি, পাপ, পুণ্য, হর্ষ, বিষাদ, মুখ, দুঃখ, দেবত্ব ও মহত্ত্বের কত অপূৰ্ব্ব অভিনয় দেখিতে দেখিতে চলিতে থাকেন। কিন্তু ঐ সকল অতিক্রম করিয়া যে সৌন্দর্য্য ও ভাবের এক অনন্ত সমুদ্র আছে, কবিরা তাহার সন্ধান পান বটে ; অথচ অনেকেই সেই সমুদ্রে গিয়া পৌছিতে পারেন না। সৌন্দর্য্যের মায়াপুরীর ভিতর যে ভাবের রাজকন্ত রহিয়াছেন ; অনেক কবি র্তাহারই আকর্ষণে আকৃষ্ট হইয়া থাকেন। এই জন্য অনেক কবিই ভক্ত নহেন। কিন্তু যিনি ভক্ত, তিনি সৌন্দৰ্য্যভাবের নদীতে কল্পনার" তরণী ভাসান না ; আপনার জীবন তরণী ভাসাইয়া দেন। তদ্ভিন্ন তাহার দৃষ্টি তীরের কোন মায়াপুরীর কোন মায়াবিনী রাজকন্যার আকর্ষণেও আকৃষ্ট হইয়া থাকে না। সেরূপ উদেশুই তাহার নয়। তিনি সৌন্দৰ্য্য ও ভাবের অনন্ত সমুদ্রের উদ্দেশেই ঘরের বাহির হইয়াছেন এবং সেই সমুদ্রে গিয়াই বিশ্রাম ওস্তৃপ্তিলাভ করেন। সুতরাং ভক্তিহীন কবি ও ভক্ত সাধকের মধ্যে এই এক পার্থক্য দেখিতেছি যে, কবি সৌন্দর্য্য ও ভাবের চরমসীমায় গিয়া উপনীত হনু না ; আর ভক্ত সৌন্দৰ্য্য ও ভাবের চরম প্রবাসী । [ ৮ম ভাগ। সীমায় গিয়াই উপনীত হন। এজন্য অনেক ভক্তিবিহীন কবি বিশ্বে কেবল সৌন্দর্য্যের লীলা ও ভাবের অভিনয়ই দেখিতে পান ; কিন্তু ভক্ত দেখেন, যেমন এক স্বৰ্য্যরশ্মিই নানা পাত্রের ভিতর দিয়া নানা বর্ণচ্ছটায় মনোরম হই। প্রকাশিত হইতেছে ; তেমনই এক অনন্ত সৌন্দৰ্য্যময় ও প্রেমময় ঈশ্বরেরই সৌন্দৰ্য্য এবং প্রেম বিচিত্র বর্ণে, গন্ধে, সুষমায় ও স্নেহকরুণায় মনোহর হইয়া এই বিশ্বে প্রকাশিত হইতেছে। - e. কিন্তু ভক্তের সঙ্গে সকল কবিরই যে উত্তমরূপ পার্থক্য আছে, তাহা নহে। যে কবির মধ্যে কবিত্ব চরমোৎকর্ষ লাভ করিয়াছে, যিনি সৌন্দর্য্য ও ভাবের শেষ সীমায় গিয়া উত্তীর্ণ হইয়াছেন, তিনিই সৌন্দৰ্য্যময় প্রেমস্বরূপকে দর্শন করিয়া ভক্ত হন। এজন্ত ভক্তিতেই কবির কবিত্বের চরমোৎকর্ষ—ইহা বলা যাইতে পারে। এখানে আর একটি কথা। ভক্তিতেই কবির কবিত্বের চরমোৎকর্ষ, তাহা যেন বুঝিলাম। কিন্তু ভক্তের অন্তরে ভক্তি সঞ্চারের সঙ্গে সঙ্গে কি কবিত্বেরও উন্মেষ হইবে । এই প্রশ্নের জবাব এক কথায় দেওয়া যায় না। প্রত্যেক ভক্ত যখন সৌন্দৰ্য্য ও ভাবের উপাসক ; তখন ভক্তের মৰ্ম্মস্থলে যে কবিত্বের মূল ভাব প্রচ্ছন্ন আছে, তাহাতে সন্দেহ নাই। তবে ভাবের অনুরূপ ভাষা না থাকায় অনেকেই তাহ প্রকাশ করিতে পারেন না। শুধু তাহাই নহে। ভক্ত অনেক সময় ভগবানের সৌন্দর্য্যে ও প্রেমে এমন উন্মত্ত হইয়া যান যে, অন্তরের ভাব বাহিরে প্রকাশ করিবার মত র্তাহার সংযম এবং শক্তিই থাকে না । o কিন্তু তথাপি প্রকৃত ভক্তের মধ্যে কবিত্বের স্ফুরণ পরিলক্ষিত হয়। ভক্তিশাস্ত্র শ্ৰীমদ্ভাগবত যিনি রচনা করিয়া ছেন, নিশ্চয়ই তিনি ভক্ত। কিন্তু শুধু কি তিনি ভক্ত | কবি না হইলে ভাগবতের স্থানে স্থানে কি কাব্যরস উচ্ছসিত হইয়া উঠিত ? পুরাতন কালের কথা নয় ছাড়য়াই দেওয় যা’ক। এই বাঙ্গলা দেশে প্রকৃত কাব্যের স্বচনা ও উহার চরমোৎকর্ষের বিষয় চিন্তা করিলেই দেখি যিনি ভক্ত, তিনিই কবি। আমাদের বক্তব্য বিষয়টি পরিস্ফুট করিবার পক্ষে, ইহা বড়ই আশ্চর্য্যের কথা যে, যে বৈষ্ণবদিগের দ্বারা বাঙ্গালির চিত্ত ১ম সংখ্যা । ] WikitanvirBot (আলাপ) ১৪:১৫, ২৪ মার্চ ২০১৬ (ইউটিসি) ভক্তিরসে আর হইছে, সেই বৈষ্ণবদিগের দ্বারাই বাঙ্গলা সাহিত্যে কবিত্বের বিকাশ হইয়াছে। , যদি এক একজন প্রসিদ্ধ ভক্তের নাম ধরিয়া আলোচনা করা যায়, অহা হইলে দেখি, তাহাদের সকলের মধ্যেই কবিত্ব ছিল। নানক, কবির ও তুলসীদাসের এক একটি উপদেশপূর্ণ শ্লোক পাঠ করুন, দেখিবেন, উহা ভাবরসে সুমধুর হইয়া উঠিয়াছে। চৈতন্যচরিতামৃতে অথবা চৈতন্ত ভাগবতে ভক্ত চৈতন্তের উক্তি পাঠ করুন, দেখিবেন উহার ভিতর কি কবিত্ব। আমরা দৃষ্টান্ত স্বরূপ ভক্ত চৈতন্তের রচিত দুইটা শ্লোক উদ্ধত করিতেছি – “ন ধনং ন জনং ন সুন্দরীং কবিতা জগদীশ কাময়ে । भन्न छनृनि छनृानौषप्द्र ভবতাগুক্তির হৈতুকী ত্বরি " अशग्रेौ* । कांश्निां उ श्रांभि ५न छन পাণ্ডিত্য সুন্দরী নারী মনের মতন। আমি চাহি জন্ম জন্ম যেন তোমাপরে অহেতুকী ভক্তি থাকে আমার অন্তরে। "নয়নং গলদশ্র ধারয়া বদনং গদগদ রুদ্ধয়া গির। পুলকৈনিচিতং বপূঃ কাল তব নাম গ্রহণে ভবিষ্যতি ", হে প্রভু, আমার কৰে অশ্রু বিগলিত হৰে নয়ন যুগল হতে, তব নাম করি , কবে গদ গদ ভাবে কণ্ঠ রুদ্ধ হয়ে যাবে পুলকে উঠবে মোর শরীর শিহরি। আমাদের এ কালের ভক্তদিগের কথা যদি আলোচনা করা যায়, তবে তাহাদের মধ্যেও কবিত্বের বিকাশ দেখিতে পাই। মহাত্মা রামকৃষ্ণ পরমহংস একজন যথার্থ ঈশ্বরভক্ত লোক। তাহার সরল মধুর এক একটি ধৰ্ম্মকথা কবির কাব্যগাথার মতই ভাবমাধুর্য্যে মনোমুগ্ধকারী। তিনি মানুষের প্রাণের ভাষাটি আবিষ্কার করিয়া যেরূপ ভাবে মনের কথা কহিয়াছেন ;– কই ? এমন ত আর কাহাকেও বলিতে শুনি না। তৎপরে আমরা মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ও মহাত্মা কেশবচন্দ্রের নামোল্লেখ করিতে পারি। শিক্ষিত লোকদিগের মধ্যে ইহারাই সৰ্ব্ববাদিসম্মত ভক্ত ছিলেন এবং ইহাদের মধ্যে কবিত্বের স্করণ হইয়াছিল। আমরা পূৰ্ব্বেই মহরি স্বরচিত "ব্ৰাহ্মধর্মের ব্যাখ্যান" হইতে কিঞ্চিৎ উদ্ধৃত করিয়াছি। তাহা পাঠ করিয়া পাঠকেরা বুঝিতে পারিয়াছেন যে, তাহার মধ্যে কিরূপ কবিত্বের বিকাশ হইয়াছিল। उद्धा ७ कवि । ASA SSASASMSMSMMSMMSMSMSMS 80 এখন ভক্ত কেশবের সেবকের নিবেদন” এন্থের “দর্শন ও নিরীক্ষণ” শীর্ষক উপদেশ হইতে কিঞ্চিৎ উদ্ভূত করিতেছি - "ব্রহ্ম পুষ্পের স্বায় ক্রমে ক্রমে ভক্তের নিকট প্রশ্নটিত হন। যদিও ব্ৰহ্ম স্বপ্রকাশ তথাপি তিনি ক্রমে ক্রমে সুন্দর হইতে সুন্দরতর হইয়া উজ্জ্বল হইতে উজ্জ্বলতর হইয়া সাধকের আত্মাতে প্রকাশিত হন। * * একটি গোলাপফুল যখন কেবল ফুটিতে আরম্ভ করে, তখন তাহার সমুদায় সৌন্দৰ্য্য প্রকাশিত হয় না ; কিন্তু ক্ৰমে ক্রমে তাহা অতীব সুন্দর হইয়া প্রশ্নটিত হয়। সেইরূপ ব্ৰহ্মপুপ ক্রমে ক্রমে তাহার সৌন্দৰ্য্যরাশি প্রকাশ করেন।" o + -- “মধুকর যেমন প্রথমে অল্পে অল্পে পুষ্পমধু পান করে, পরে ক্রমশঃ পুষ্পের মধ্যে প্রবেশ করিয়া মত্ত হইয়া যায়, ভক্ত সাধকও সেইরূপ প্রথমাবস্থায় বারংবার ঈশ্বরকে দর্শন করেন। * - যদি ভক্তি নয়নে দেপ ব্ৰহ্মকে নিকটে দেখিতে পাইবে এবং দেখিবে সেই একজন ক্রমাগত নুতন নুতন বেশ করিতেছেন, নূতন নূতন সৌন্দৰ্য্য প্রকাশ করিতেছেন।" ইহা কেবল উৎকৃষ্ট ধৰ্ম্মকথা নহে। উত্তম কাব্যের এক একটি অংশও বটে। যাহা হো’ক যাহার অস্তরে ভক্তির বিকাশ হইয়াছে, তাহার চিত্তে কবিত্বেরও উন্মেষ হইবে, তাহা আমরা সপ্রমাণ করিলাম। এখন দেখাইব, যে কবির মধ্যে কবিত্ব চরমোৎকৰ্ষ লাভ করিয়াছে, তাহার মধ্যে ভক্তিরও স্ফূরণ হইয়াছে।” ইহা দেখাইবার জন্ত বাঙ্গলা দেশে বিশেষ ক্লেশ স্বীকার করিতে হয় না। সৰ্ব্বোৎকৃষ্ট কাব্যের লক্ষণ যদি ইহাই হয় যে, উহা পড়িতে পড়িতে ছায়া-শরীরী সৌন্দৰ্য্য ও ভাব কায় ধাঁরণ করিয়া পাঠকের সম্মুখে আসিয়া উপস্থিত হয়, এবং পাঠকের মূলকে মায়ার মুগ্ধ করিয়া এক বিচিত্র-লোকে লইয়া যায়, তাহা হইলে বলিতে হইবে, বাঙ্গলা সাহিত্যে প্রকৃত কবিত্বের উন্মেষ হইয়াছিল বৈষ্ণব কবিদিগের মধ্যে, এবং বিকাশ হইয়াছে রবীন্দ্রনাথের কবিতার। আশ্চর্য্যের বিষয় এই যে, বৈষ্ণব কবিদিগের মধ্যে অনেকেই যথার্থ ভক্ত ছিলেন। প্রকৃতির সৌন্দৰ্য্য এবং মানবীয় প্রেমের মধ্য দিয়াই তাহারা শিবসুন্দরের অনন্ত রূপমাধুরী ও অসীম প্রেম দর্শন করিয়াছিলেন। কবি রবীন্দ্রনাথ কবিত্বের মধ্য দিয়া ভক্তিতে গিয়া পৌছিয়াছেন ; বিশ্বের সৌন্দৰ্য্য ও মানবের প্রেমের ভিতরই অসীমের মহা প্রকাশ দেখিতে পাইয়াছেন। বৈষ্ণব কবিদিগের বিষয় সকলেই জানেন। তাহাম্বের ভক্তিরসাত্মক কবিতা সকলেই পাঠ করিয়াছেন। আমরা রবীন্দ্রনাথের ভক্তিরসাত্মক কবিতা সম্বন্ধেই কিঞ্চিৎ আলোচনা করিয়া এই সুদীর্ঘ রচনাটি সমাপ্ত করিব। -